বিএনপির প্রতীকে নির্বাচিত এক সদস্য এরই মধ্যে সংসদে যোগ দিয়েছেন। জোটের আরেক সদস্যও শপথ নিতে যাচ্ছেন আজ মঙ্গলবার। বিএনপির নির্বাচিত ছয় সদস্যও ভেতরে ভেতরে সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু কৌশলগত কারণে এ বিষয়ে তাঁরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারছেন না। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন তাঁরা। আবার বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। নির্বাচিত আট সংসদ সদস্যের সবাই শপথ নিয়ে সংসদে গেলে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ নির্বাচিত ওই আটজন ছাড়া দুই জোটের প্রায় সব নেতাই শপথ নেওয়ার বিরুদ্ধে। বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলীয় ও জোটগত সিদ্ধান্ত অমান্য করে গত ৭ মার্চ শপথ নিয়েছেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ। গণফোরাম থেকে নির্বাচিত আরেক সংসদ সদস্য মো. মোকাব্বির খান আজ শপথ নেবেন বলে স্পীকারকে চিঠি দিয়েছেন।
তিনি দাবি করেছেন, দলীয় প্যাড ব্যবহার করেই শপথ নেওয়ার বিষয়ে স্পিকারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং এ ব্যাপারে তাঁর দল গণফোরামের অনুমতিও আছে। তিনি বলেন, ‘আমি গণফোরামের সিদ্ধান্তেই শপথ নিচ্ছি। আমাকে পার্টি থেকে শপথ নিতে বলা হয়েছে। সেই হিসেবে আমি সোমবার স্পিকারকে চিঠি পাঠিয়েছি।’
তবে গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী গতকাল সোমবার রাতে বলেন, ‘মোকাব্বির খানের শপথ নেওয়ার বিষয়ে দলের কোনো অনুমতি নেই। সংসদে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তই বহাল আছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মোকাব্বির দলীয় প্যাড চুরি করে ওই চিঠি পাঠিয়েছেন। এটি প্রতারণা ও ফ্রড। শিগগিরই দলের সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
এদিকে সংসদ সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, মোকাব্বির খানের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শপথ নেওয়ার প্রশ্নে সবচেয়ে বেশি আপত্তি রয়েছে ২০ দলীয় জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর মধ্যেই। ফলে বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নিলে ২০ দলীয় জোট এমনকি ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন অনেক নেতা। কারণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল নির্বাচন বর্জন করে এরই মধ্যে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সংসদে না যাওয়ার বিষয়ে অবস্থান নিয়েছে।
নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর বলেছেন, ওই নির্বাচন বাতিল করা হোক। ড. কামাল হোসেনও নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি তোলেন। শুধু তা-ই নয়, সুলতান মনসুরের শপথগ্রহণের পর এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, যারা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয় তারা দালাল।
যদিও অনুরোধ করে এ পর্যন্ত গণফোরাম নেতা মোকাব্বিরের শপথগ্রহণ আটকে রেখেছেন ড. কামাল। কিন্তু তার পরও কামাল হোসেনের রাজনৈতিক আদর্শ এবং তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতি নিয়ে বিএনপির বড় একটি অংশের আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে, বিএনপির সঙ্গে জোট করে এবং বিএনপি নেতাদের পাশে বসিয়ে তিনি সারা দিন ‘বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতার’ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলেন, যা বিএনপির কাছে বেশ অস্বস্তিকর। যদিও কৌশলগত কারণে বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা বেশ ক্ষুব্ধ। তা ছাড়া বিএনপির প্রস্তাব সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেনের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘটনা বিএনপিতে এখন বেশ আলোচিত। কেউ কেউ তাঁর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ করেন বলেও জানা যায়।
জানা যায়, ওই সব ঘটনার রেশ বা প্রতিক্রিয়া হিসেবেই গত রবিবার এক আলোচনাসভায় বিব্রতকর পরিস্থিতির তৈরি হয়। ড. কামালের বক্তৃতার সময় বিএনপির উপস্থিত কর্মীরা দাবি তোলেন যে ‘জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন’ এ কথা বলতে হবে। তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগানও দেয়। এমন পরিস্থিতিতে সুলতান মনসুরের পর এখন গণফোরামের মোকাব্বির শপথ নিলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। যদিও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল জানান, সংসদে না যাওয়ার বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত এখনো বহাল আছে।
২০ দলীয় জোটের প্রধান সমন্বয়ক এলডিপির চেয়ারম্যান ড. অলি আহমদ গত ২৫ জানুয়ারি এক বক্তৃতায় বলেন, বিএনপি সংসদে যোগ দিলে প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত হবে। কারণ বিএনপি এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে।
এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি সংসদে যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। ৩০ ডিসেম্বর কোনো নির্বাচন হয়নি। ২০ দল এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এই নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই ভুলক্রমে যারা এমপি হয়েছেন তাঁরা সংসদে গেলে সেটি এলডিপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাঁরা বেইমান হবেন।’
বিএনপির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত দুটি কারণে সংসদে যোগদান প্রশ্নে বিএনপির ভেতরে আলোচনা উঠেছে। প্রথমত, দলীয় রাজনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে বিষয়গুলো নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এখনো আলোচনা হয়নি। তা ছাড়া দলের স্থায়ী কমিটির বেশির ভাগ সদস্যও সংসদে যাওয়ার বিপক্ষে। তাঁদের মতে, নির্বাচন বর্জন ও প্রত্যাখ্যানের পর সংসদে যোগ দিলে দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হবে। এ অবস্থায় ‘রাজনীতি’ বলতে আর কিছু থাকবে না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের সংসদে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যাঁরা জয়লাভ করেছেন তাঁরা সবাই যেতে চাইবে এটি স্বাভাবিক। তবে পাঁচ-সাতজন সংসদে যোগ দিলেই দলের অস্তিত্ব থাকবে বা সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে—এটা চিন্তা করা অবান্তর।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘সংসদে যোগ দেওয়ার কোনো খবর আমার জানা নেই। তার পরও কখন কী ঝড় ওঠে বলা যায় না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যে নির্বাচন হয়ে গেল ওই নির্বাচনে যদি অংশ নেওয়া যায় তাহলে সংসদে গেলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।’ তাঁর দাবি, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যাওয়ার বিরুদ্ধেও বিএনপির ৯৯ শতাংশ নেতাকর্মী ছিল, সংসদে যোগদানের বিরুদ্ধেও ৯৯ জনই আছে।