বনানী এফআর (ফারুক-রূপায়ন) টাওয়ারের মূল নথি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর ওই টাওয়ারের ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত অংশের জমাকৃত নকশা জাল বলে মনে করছে রাজউক। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর গণমাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য মিলেছে, ২৩ তলার ইমারতের নকশাটি জাল হওয়ার কারণে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রূপায়ন গ্রুপ রাজউকের মূল ফাইলটি গায়েব করে ফেলেছে। রাজউকের কাছে এমন অভিযোগ জানিয়েছেন ওই জমির লিজ গ্রহীতা এসএমএইচআই ফারুক।
রাজউকের চিঠির জবাবে ২০১০ সালের ২৫ মে এস্টেট-১ শাখায় উপস্থিত হয়ে লিজ গ্রহীতা ফারুক লিখিতভাবে জানান, রূপায়ন হাউজিং এস্টেটের সঙ্গে আমি ১৮ তলা ইমারত নির্মাণের জন্য চুক্তিবদ্ধ হই। কিন্তু আমমোক্তার গ্রহীতা রূপায়ন নকশা জাল করে ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত ইমারত নির্মাণের নকশা দাখিল করে। এ বিষয়ে চিঠিতে বিস্তারিত উল্লেখ করে এ কাজের জন্য তিনি রূপায়নকে দায়ী করেন এবং তাদের লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানান।
এছাড়া ২০১৩ সালের ২৭ এপ্রিল লিজ গ্রহীতা ফারুক রাজউকের কাছে এক আবেদনে রূপায়নের বিক্রি করা স্পেসগুলো নিয়মনীতি মোতাবেক হয়েছে কিনা তা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য অনুরোধ জানান।
এ প্রসঙ্গে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকটে শ. ম. রেজাউল করিম মঙ্গলবার বলেন, ‘বনানী এফআর টাওয়ারের মূল নথি রাজউকে নেই; সেটা খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ওই ফাইলের একটি ফটোকপি নথি রয়েছে, সেখানে দুটি নকশা রয়েছে। একটি ১৮ তলা পর্যন্ত এবং অপরটি সংশোধিত নকশা, যেখানে ১৯ থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৭ সালে ওই ফাইলের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি তদন্ত কমিটি করে রাজউক। সেখানে ফটোকপি করা ফাইলে ১৮ তলা পর্যন্ত নকশা অনুমোদনের সত্যতা মিলেছে। আর পরবর্তী পাঁচতলার ফটোকপি নথির সত্যতা মেলেনি। এ কারণে আমরা ধরে নিচ্ছি, ওই পাঁচতলার নকশা জাল বা ওই অংশ অবৈধ। তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আরও পরিষ্কারভাবে আপনাদের জানাতে পারব।’
এদিকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাজউকের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। বেশির ভাগ কর্মকর্তা প্রতিবেদকের মুঠোফোন রিসিভ করেননি। কেউ কেউ খুদে বার্তার জবাবও দেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, আমরা এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাচ্ছি তাতে মনে হয়েছে, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী এফআর টাওয়ারের বিদ্যমান জায়গার ওপর ১৮ তলার উপরে আর কোনো ফ্লোর নির্মাণের আইনগত সুযোগ ছিল না। কিন্তু রূপায়ন গ্রুপ বেশি মুনাফার জন্য শুরু থেকেই ওই ভবনে বর্ধিত অংশ নির্মাণ করার ব্যাপারে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। মূলত ২০০৩ সালে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আমমোক্তারনামা) নিয়োগ হওয়ার পর থেকেই এফআর টাওয়ারে অবৈধভাবে অফিস স্পেস বানানোর নানা তৎপরতা চালায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। এরই অংশ হিসেবে এফআর টাওয়ারের মূল ফাইল রাজউক থেকে গায়েব হয়ে যায়।
এ সুযোগে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি ধাপে ধাপে ১৯ থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। অপর একটি সূত্র জানায়, এ প্রক্রিয়ায় জালজালিয়াতি করে কিছু কাগজপত্র তৈরি করা হতে পারে। যার সঙ্গে রাজউকের তৎকালীন সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে। যে কারণে নিজেদের দায় এড়াতে তারা এফআর টাওয়ারের মূল নথি গায়েব করে ফেলে।
সূত্র জানায়, নিলামের সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে বনানীর ১৭ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর প্লটটির সাময়িক বরাদ্দপত্র পান এসএমএইচআই ফারুক। ১৯৮৫ সালের ১৮ মে নিলাম ডাকে ওই প্লটটির জমির পরিমাণ ছিল ছয় কাঠা চার ছটাক। বরাদ্দ পাওয়ার পর নিয়মানুযায়ী জামানত ও প্রথম কিস্তি পরিশোধ করেন তিনি। এরপর একই বছরের ২৩ জুন ফারুককে চূড়ান্ত বরাদ্দপত্র দেয় রাজউক। ২৪ সেপ্টেম্বর বরাদ্দ গ্রহীতাকে দখল হস্তান্তর করা হয়।
দখল হস্তান্তরের সময় জমির পরিমাণ পাওয়া যায় আট কাঠা আট ছটাক ২২ বর্গফুট। জমির পরিমাণ বেশি হওয়ায় নিয়ম মোতাবেক বরাদ্দ গ্রহীতা বর্ধিত জমির মূল্য পরিশোধ করেন। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে প্লটের বিপরীতে সমুদয় কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন তিনি। সমুদয় অর্থ পরিশোধের পর ১৯৮৯ সালের ২৫ জুন লিজ দলিল রেজিস্ট্রি করে নেন ফারুক।
সূত্র আরও জানায়, রূপায়ন গ্রুপ আমমোক্তারনামা নেয়ার পর থেকেই এফআর টাওয়ার নিয়ে নানা ঘটনার জন্ম হতে থাকে। ২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি এফআর টাওয়ারের ২০, ২১ ও ২২ তলা জিএসপি ফাইন্যান্স বাংলাদেশ লিমিটেডের কাছে বন্ধক রাখার অনুমতি চেয়ে রাজউকের কাছে আবেদন করে ডেভেলপার কোম্পানি রূপায়ন গ্রুপ। আবেদনের সঙ্গে ১৯৯৪ সালের ১২ ডিসেম্বর ২৩ তলা ভবনের নকশা দাখিল করে কোম্পানিটি।
এর ভিত্তিতে বন্ধক অনুমতি দেয়া হয়। তবে ২০০৭ সালের ৭ আগস্ট ‘ফিডিলিটি অ্যাসেটস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেড’র কাছ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ নিতে বন্ধক অনুমতি চেয়ে আবেদন করে রূপায়ন গ্রুপ। এ সময় তারা ২৩ তলার বদলে ১৮ তলা ইমারতের নকশা দাখিল করে। দুই দফায় ১৮ ও ২৩ তলার পৃথক নকশা দাখিলের পর রাজউকের এস্টেট শাখার সন্দেহ দেখা দেয়।
এর ভিত্তিতে নকশা যাচাই করতে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট এস্টেট শাখা নকশা অনুমোদন শাখায় একটি চিঠি পাঠায়। ওই চিঠিতে এস্টেট শাখা বনানী বাণিজ্যিক এলাকার ১৭ নম্বর রোডের ৩২ নম্বর প্লটে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা জানাতে এবং অনুমোদিত নকশা সরবরাহ করতে অনুরোধ জানায়।
পরবর্তীকালে একই বছরের ২৮ আগস্ট নকশা অনুমোদন শাখায় ফিরতি চিঠিতে জানায়, বনানী বাণিজ্যিক এলাকার ১৭ নম্বর রোডের ৩২ নম্বর প্লটের ওপর নির্মিত ইমারতের (এফআর টাওয়ার) অনুমোদিত নকশা রেকর্ডে পাওয়া যায়নি। ওই চিঠিতে এস্টেট শাখা অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা জানাতে এবং অনুমোদিত নকশা সরবরাহ করতে অনুরোধ জানায়।
একই বছরের ২৮ আগস্ট নকশা অনুমোদন শাখা ফিরতি চিঠিতে জানায়, ইমারতের অনুমোদিত নকশা রেকর্ডে পাওয়া যায়নি। কিন্তু ইস্যু রেজিস্টারে দেখা যায়, ১৮ তলার নকশা অনুমোদিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নকশা অনুমোদন শাখা থেকে চিঠি পাওয়ার পর ২০০৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর লিজ গ্রহীতা ফারুককে একটি চিঠি দেয় রাজউকের এস্টেট শাখা। ওই চিঠিতে জানানো হয়, অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে অননুমোদিতভাবে ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে। তাই ঋণ গ্রহণের আবেদন বিবেচনা করার অবকাশ নেই।
এদিকে রূপায়ন গ্রুপের ডিজিএম সাইফুল ইসলাম উল্লেখিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করে মঙ্গলবার বলেন, ‘২০০৩ সালে জমির আমমোক্তারনামা নেয়ার পর ২০০৪ সালের শেষদিকে সংশোধিত নকশার জন্য রাজউকে আবেদন করা হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে রাজউক ২৩ তলা ভবনের নকশা অনুমোদন করে। এরপর আমরা কাজ শুরু করি এবং ২০০৮ সালে এফআর টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, ১৯৯০ সালে প্লটটির লিজ গ্রহীতা এসএমএইচআই ফারুক ১৫ তলা ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন করেন।
কিন্তু তিনি ওই নকশায় ভবন নির্মাণ করেননি। পরবর্তীকালে ১৯৯৬ সালে তিনি পুনরায় নকশা পরিবর্তন চেয়ে আবেদন করেন এবং সে অনুযায়ী ১৮ তলার অনুমোদন পান।’