শিক্ষাব্যবস্থা : ফিরিয়ে দাও হারিয়ে যাওয়া আট বছর

মহসীন হাবিব

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। ফাইল ছবি


তিনি আরেকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন যা সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তিনি শিক্ষা বিভাগের দুর্বলতা ঢাকতে পাসের হার মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আইওয়াশ যাকে বলে। ফলে গরু-ছাগল টেবিল-চেয়ার সব পাস করে গেছে। একদিকে সেটা যেমন সার্টিফিকেটধারী বেকারের সংখ্যা বাড়িয়েছে, তেমনি একটি লেখাপড়ায় দুর্বল কয়েকটি প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে (অবশ্য সবাই না, বেশির ভাগ)।

স্কুল-কলেজ জীবনে ইতিহাস পড়তে গিয়ে প্রায়ই খটকা লাগত, কুখ্যাত-বিখ্যাত সেনাপতি এবং অভিযানকারীরা কোনো জনপদ দখল করে লাইব্রেরি-বিদ্যাপীঠ কেন ধ্বংস করে দিতেন! দ্বাদশ শতকের বাগদাদ ছিল আলোকিত একটি শহর। শিল্পকলা, বিজ্ঞানচর্চা গ্রীক সাহিত্য, দর্শনচর্চার পীঠস্থান। তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক লেখাপড়া জানা লোক বাস করত বাগদাদে। বায়তুল হিকমা বা হাউস অব উইজডম ছিল আব্বাসীয় শাসনকালের সুবিশাল এক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির একটি অংশ ছিল খিজানাতুল হিকমা বা স্টোর হাউস। এই স্টোর হাউসে ছিল অসংখ্য মূল্যবান পান্ডুলিপি। গ্রীকসহ নানা ভাষা থেকে হাজার হাজার অনুবাদ, প্রাচীন দর্শন, বিজ্ঞানের উপর লেখা রত্নভাণ্ডার। ১২৫৭ সালে মোঙ্গল শাসক হালাকু খান আব্বাসীয় খলিফা আল মুহতাসিম বিল্লাহর কাছে দূত পাঠান তার বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য। কিন্তু বিল্লাহ সেটা অস্বীকার করলে তাইগ্রিস নদী পার হয়ে হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করেন। সে বিরাট ইতিহাস। বাগদাদ আক্রমণ করে অসংখ্য মানুষ হত্যার পাশাপাশি অত্যন্ত ‘যত্নের সঙ্গে’বাগদাদের এই লাইব্রেরিটা পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেন! এই লাইব্রেরির বিশালত্ব নিয়ে বহু ধরনের গল্প চালু আছে।

বিশ্বের অন্যতম প্রচীন বিদ্যাপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ধ্বংস করেছিলেন মধ্য এশিয়ার শাসক মাহিরকুলা ৪৫৫ থেকে ৪৬৭ খৃস্টাব্দের কোনো এক সময়। কিন্তু সেটিকে আবার পুনরায় গড়ে তুলেছিলেন গুপ্তবংশের সম্রাট স্কন্দগুপ্ত। দ্বিতীয়বার সপ্তম শতাব্দিতে এটি ধ্বংস করেন গৌড়ের শাসকরা। কিন্তু বৌদ্ধ রাজা হর্ষবর্ধন সেটিকে আবার পুনরায় গড়ে তোলেন। দ্বাদশ শতাব্দিতে এটিকে আবার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন তুর্কি সেনাপতি বখতিয়াল খিলজি।  লোকমুখে শোনা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর লাইব্রেরি এত বিশাল ছিল যা সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যেতে তিন মাস সময় লেগেছে।

universel cardiac hospital

এই প্রত্যেক আক্রমণকারীই শুধু লাইব্রেরি ধ্বংস করে ক্ষান্ত হননি, তারা লাইব্রেরিকেন্দ্রিক সব জ্ঞানী মানুষদেরও হত্যা করেছিলেন। একপর্যায়ে বখতিয়ার খিলজি অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সঙ্গী চিকিৎসকরা তাকে সুস্থ্য করে তুলতে ব্যর্থ হন। তখন তিনি বাধ্য হয়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল রাহুল শ্রীভদ্রের চিকিৎসা গ্রহণ করেন এবং সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাতেও খিলজি কোনো ছাড় দেননি। সুস্থ হয়েই খিলজি নালন্দা ধ্বংস করে দেন। তার মানে, নালন্দা ধ্বংস করা তার কাছে যুদ্ধের অপরিহার্য কাজ বলে মনে হয়েছে।


প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে অনেকটা শেকলের মতো। আপনি মাঝখানে যদি একটি বা দুটি প্রজন্মকে দুর্বল করে তোলেন তাহলে পেছনের সব প্রজন্ম দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠতে থাকবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মন্ত্রীত্বকালীন সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চোখে পরার মতো দুর্বলতা দেখা গেছে।

মধ্যযুগের এসব কাহিনিকে আগে মনে হতো-এ শুধুই ধ্বংসের উম্মাদনা। পরে পরিণত বয়সে বুঝতে পেরেছি, এ শুধু ধ্বংস নয়-একটি জাতিকে মেধাশূন্য করার সুদূরপ্রসারি চিন্তা। কারণ মেধাশূন্য জাতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। না সমরে, না শান্তিতে, না উন্নয়নে। আর একটি মেধাবী জাতিকে কোনোদিন তলোয়ার দিয়ে নত করে রাখা যায় না। মেধা তথা শিক্ষা একটি জাতির জন্য এতটাই অপরিহার্য! কিন্তু বহিঃশত্রুর আক্রমণ ছাড়াই যদি কোনো জাতি মেধাশূন্য হয়ে পড়ে, তার দায় কার?

একটি জাতির মেধার ব্যবহার এবং মেধাবী প্রজন্ম গড়ে তোলায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র যদি মেধা সৃষ্টিতে সঠিক ও সময়োপযোগি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারে, তবে মেধার বিকাশ থমকে যায়।  তাই আজ বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের মেধা নিয়ে সত্যিই আমরা আতঙ্কিত। কারণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে অনেকটা শেকলের মতো। আপনি মাঝখানে যদি একটি বা দুটি প্রজন্মকে দুর্বল করে তোলেন তাহলে পেছনের সব প্রজন্ম দুর্বল হয়ে বেড়ে উঠতে থাকবে। দুর্ভাগ্যক্রমে সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মন্ত্রীত্বকালীন সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় চোখে পরার মতো দুর্বলতা দেখা গেছে।

সর্বমহলে তিনি সজ্জন হিসাবেই পরিচিত। ২০০৯ সাল থেকে টানা ৮ বছর তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু কেন এই সজ্জন বলে পরিচিত মানুষটির অধীনে মন্ত্রণালয়টি ভোলাটাইল অবস্থায় পতিত হয়েছিল? তার সময়ে পাঠ্যপুস্তকে ভুল সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বছরের পর বছর তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া ঠেকাতে পারেননি। আমরা ভেবেছিলাম বাম রাজনৈতিক মতাদর্শের এই মানুষটির অধীনে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন যথেষ্ট কড়া এবং শক্ত হয়ে ওঠবে। কিন্তু ঘটেছে তার উল্টো। তিনি সহনশীল পর্যায়ে ঘুষ খাওয়ার পরামর্শ দিয়েও পার্লামেন্টে এবং পার্লামেন্টের বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।

তিনি আরেকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন যা সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তিনি শিক্ষা বিভাগের দুর্বলতা ঢাকতে পাসের হার মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আইওয়াশ যাকে বলে। ফলে গরু-ছাগল টেবিল-চেয়ার সব পাস করে গেছে। একদিকে সেটা যেমন সার্টিফিকেটধারী বেকারের সংখ্যা বাড়িয়েছে, তেমনি একটি লেখাপড়ায় দুর্বল কয়েকটি প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছে (অবশ্য সবাই না, বেশির ভাগ)।

এখন নতুন শিক্ষামন্ত্রী এসেছেন। তিনি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ভালোই চালিয়েছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হচ্ছে ভালোই করবেন। দেখা যাক। কিন্তু নাহিদ সাহেবের সময়ের ক্ষতিটা কি আমরা পুষিয়ে নিতে পারব? সেটাও ভবিষ্যত বলবে। তবে শ্রদ্ধেয় নাহিদ সাহেবের সময়ের ভুল সিদ্ধান্তগুলো শিগগির সংশোধন করা দরকার বলে মনে করি। শিশুসন্তানদের ঘাড়ে অনেক বইয়ের বোঝা কমাতে হবে, কারিকুলামে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে, শিক্ষা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। তাহলেই কেবল বলা যাবে যে, পরিবর্তন এসেছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে