মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো উন্নয়ন প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না বলে ১১৮টি প্রকল্প অসমাপ্ত রেখেই শেষ হতে চলেছে চলতি অর্থবছর (২০১৮-১৯)। আর সময়মতো প্রকল্প শেষ না হওয়ায় এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ।
জানা যায়, অর্থবছরের শুরুতে ৪৪৬টি প্রকল্প সমাপ্ত হবে বলে জানানো হলেও মাঝপথে এসে সে অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। যে কারণে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫টি।
সম্প্রতি অনুমোদন পাওয়া সংশোধিত এডিপিতে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেসব প্রকল্প যাতে সময়ের মধ্যে শেষ করা হয় সেটি নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে চিঠি দিচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন।
কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ থেকে দু-এক দিনের মধ্যেই তাগাদা দিয়ে এ চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, সার্বিকভাবে প্রকল্প সময়মতো শেষ না হওয়ার নানাবিধ কারণ তুলে ধরেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
সূত্র জানায়, মূল এডিপিতে যেসব প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্য ছিল তার মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ৪৩০টি এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৬টি। সংশোধিত এডিপিতে যেসব প্রকল্প শেষ করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ৩২৮টি এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্প রয়েছে ১৭টি। এক্ষেত্রে ১০২টি বিনিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অপরদিকে একটি কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের বাস্তবায়ন বেশি হবে।
এ প্রসঙ্গে আইএমইডির ভারপ্রাপ্ত সচিব আবুল মনসুর মো. ফায়েজ উল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রকল্প সময়মতো শেষ না হলে সেটি থেকে যে ফল পাওয়ার কথা তা থেকে বঞ্চিত হয় জনগণ। এছাড়া প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এক কথায় সব দিক থেকেই ক্ষতি হয়। সার্বিক আর্থিক শৃঙ্খলার ব্যত্যয় ঘটে। তবে নিবিড় পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করা গেলে অনুমোদিত ব্যয় ও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের আওতাভুক্ত অঙ্গগুলোর মানসম্মত ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অনেকাংশে সহজ হবে।
সংশোধিত এডিপিতে চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ জুনের মধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে কথা, সেগুলোর মধ্যে পরিবহন খাতের সর্বোচ্চ ৫২টি প্রকল্প রয়েছে। এছাড়া কৃষি খাতের রয়েছে ৪১টি প্রকল্প, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতের ২৯টি, পানি সম্পদ খাতের ২৪টি, শিল্প খাতের ১১টি, বিদ্যুৎ খাতের ১৭টি, তৈল গ্যাস ও প্রকৃতিক সম্পদ খাতের ৩টি, যোগাযোগ খাতের ৬টি, ভৌত-পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতের ৪৪টি, শিক্ষা ও ধর্ম খাতের ২৬টি, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতের ১৬টি, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ খাতের ২৫টি, গণসংযোগ খাতের ৫টি, সমাজকল্যাণ-মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন খাতে ৯টি, জনপ্রশাসন খাতে ১৪টি, বিজ্ঞান-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ১১টি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে ৪টি। বিনিয়োগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে কৃষি খাতের ১০টি, শিল্প খাতের তিনটি, পরিবহন খাতে তিনটি এবং স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতের একটি প্রকল্প রয়েছে।
যেসব প্রকল্প শেষ করা হবে সেগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ প্রকল্পটি অন্যতম। এটি ২০১৪ সালের জুলাইয়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শেষ করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এর মধ্যে আবারও ৬ মাস মেয়াদ বাড়িয়ে জুন করা হয়। মোংলা বন্দর হতে পশুর চ্যানেল পর্যন্ত ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পটিও শেষ করার কথা জানিয়েছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে আরও দুটি প্রকল্প রয়েছে এ তালিকায়।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের রুজভেল্ট জেটির বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মোংলা বন্দরের জন্য টাগবোট সংগ্রহ প্রকল্পটি। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলওয়ে লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১০ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল।
কিন্তু নানা কারণে প্রকল্প সংশোধন করায় সেটি সম্ভব হয়নি। অবশেষে জুনে সেটি সমাপ্ত করা হচ্ছে। লাকসাম এবং চিনকী আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি ২০০৭ সাল থেকে গত বছরের অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। এর মাঝে দু’বার সংশোধনও করা হয়। এটি জুনের মধ্যে শেষ হবে।
বিদ্যুতের যেসব প্রকল্প শেষ করা হবে :
তা হলো ১৩২ কেভি গ্রিড নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ইন ইস্টার্ন রিজিওন, আশুগঞ্জ-ভুলতা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ, বাংলাদেশ (ভেড়ামারা)-ভারত (বহরমপুর) বিদ্যমান গ্রিড আন্তঃসংযোগের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ, বিবিয়ানায় তৃতীয় ৪০০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পল্লীবিদ্যুৎ সম্প্রসারণ ঢাকা বিভাগীয় কার্যক্রম-২, রাজশাহী-রংপুর বিভাগীয় কার্যক্রম-২, চট্টগ্রাম-সিলেট বিভাগীয় কার্যক্রম-২, খুলনা বিভাগীয় কার্যক্রম-২, বরিশাল বিভাগীয় কার্যক্রম-২ এবং কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড এক্সপানশন অব ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক অব নর্থ অ্যান্ড সাউথ জোন আন্ডার ডিপিডিসি প্রকল্প।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) বৈঠকে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে আইএমইডি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্প গ্রহণে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না করে এবং ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন করা হয়। ফলে কাজের পরিধি বেড়ে যায়, এতে ব্যয় বৃদ্ধি পায়।
এতে আরও বলা হয়, প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে মার্কেট অ্যানালাইসিস না করা, বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বিবেচনা না করেই প্রকল্প গ্রহণ, প্রকল্পের লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্কে পরিমাণগত ইউনিট বা সংখ্যা যথাযথভাবে প্রণয়ন না করা, বাস্তবায়নযোগ্য কর্ম পরিকল্পনা ও প্রকিউরমন্ট প্ল্যান তৈরি না করা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি বা একজন প্রকল্প পরিচালক একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ও অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করাও ব্যয়বৃদ্ধি ও সময় লাগার কারণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বেড়ে যায় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরপত্রের রেট সিডিউল পরিবর্তন হয়ে যায় এবং প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। এছাড়া নির্মাণ কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ নিবিড় মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে।