যে’কটা ব্যান্ডদল বাংলাদেশে রক গানের প্রচলন করেছে, শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম লাভ রানস ব্লাইন্ড বা এলআরবি। কিংবদন্তি এই ব্যান্ডের গানে উন্মাদনায় মেতে ওঠেননি, এমন শ্রোতা পাওয়া দুষ্কর। উপমহাদেশের বিখ্যাত গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে সৃষ্টি হওয়া এলআরবি এক এক করে পার করেছে ২৮টি বছর।
কিন্তু এরই ফাঁকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন এর ভোকাল ও প্রতিষ্ঠাতা আইয়ুব বাচ্চু। গত বছরের ১৮ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন কিংবদন্তি এই ব্যান্ড তারকা। যার ফলে গোটা দেশ শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। থমকে যায় এলআরবি’র পথচলা। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ব্যান্ডটির আগামী।
তবে ‘শো মাস্ট গো অন’ সূত্রে এলআরবি’কে আবারও কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আর তাই নতুন ভোকাল যুক্ত করেছে ব্যান্ডটি। এলআরবি’র নতুন ভোকাল বালাম। ৫ এপ্রিল, শুক্রবার ব্যান্ডটির ২৭ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে বালামকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
এদিকে এলআরবি’র নতুন ভোকাল হিসেবে বালামকে মেনে নিতে পারছেন না ব্যান্ডটির ভক্তরা। রীতিমত ক্ষেপেছেন তারা। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে সেই ক্ষোভের রেশ। এলআরবি’র অফিশিয়াল ফেসবুক পেজেই অসংখ্য মন্তব্য দেখা যাচ্ছে, যেগুলোতে ভক্তরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
রাশেদ মজুমদার নামের এক ভক্ত লিখেছেন, আপনাদের (এলআরবি) উচিৎ ছিলো এর গানগুলি কয়েকজন পুরনো কিংবা নতুন শিল্পীর কাভার করে বাজারে ছাড়া, এবং পাবলিক যাকে বেশি গ্রহন করবে তাকে ভোকালিস্ট বানানো।
জালাল উদ্দিন রূপক নামের এক ভক্ত লেখেন, বালামকে কোনভাবেই যায়না। আরও অনেকেই ছিল। নোবেলকে সাইড ভোকাল হিসেবে একটা সুযোগ দেয়া যেতো। আর হুট করেই বালামকে দেয়া ঠিক হয়নি। বালামের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেও দারুণ মিউজিক করে। তবে সাইড ভোকাল হিসেবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতো। সারাদেশ থেকে ঝাঁঝালো কন্ঠের ছেলেরা ট্রাই করতো। অতঃপর সাইড ভোকাল হিসেবে কয়েকজনকে নেয়া যেতো। বাচ্চু ভাইয়ের সম্মানার্থে মূল ভোকাল জায়গাটা শূন্য রাখা উচিত ছিল। পরবর্তীতে যদি কেউ লিজেন্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো, তখন বামবা ও এলআরবি’র সদস্যদের পরামর্শ মোতাবেক মূল ভোকাল হিসেবে কাউকে আসীন করা যেত।
শামস সজীব নামের একজন লিখেছেন, বালাম একক গায়ক হিসেবে ভালো। কোনোভাবেই বালামের ভয়েসে বাচ্চু ভাইয়ের গাওয়া রক মিউজিক নিতে পারা সম্ভব না! নতুন কাউকে আনতে পারতেন আপনারা! নোবেল ছেলেটার গলায় বাচ্চু ভাইর যোগ্য উত্তরসূরী হওয়ার মত সবচেয়ে বেশি জোর ছিল।
তৌফিক মিথুন নামের আরেক ভক্ত লেখেন, বাচ্চু ভাই নাই, তাই বলে বালাম? এবার ‘তারা ভরা রাতে’ও নাকি কন্ঠে ইঁ ইঁ নাঁ রিঁ নাঁ রেঁ নাঁ টোনে শুরু হবে! বালাম ভাই মিউজিশিয়ান হিসাবে ভালো, তবে বাচ্চু ভাইয়ের গায়কী উনার কন্ঠে মানাবে না। মনে পড়ে অনেক দিন আগে, ‘ডি-রকস্টার’ নামে একটা প্রোগ্রামে বাচ্চু ভাই নিজেই বিচারক হিসেবে ছিলেন। ওখানে উনিই বেশ কয়েকজনকে প্রশংসা করেছিলেন, যারা উনার গানকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলো। দুজনের নাম মনে পড়ে, শুভ আর নিলয়। এরা কে কোথায় আছে জানি না। তবে শুভ ফুয়াদ ভাইয়ের বিভিন্ন মিক্সড এলবামে কন্ঠ দিয়েছিলো। জানি বাচ্চু ভাইয়ের রিপ্লেসমেন্ট সম্ভব না, তবুও একটা অডিশনের মাধ্যমে তুলনামূলক কাছাকাছি গায়কির কাউকে তুলে আনা গেলে শ্রোতাদের ভালো লাগতো।
ফয়সাল আহমেদ সুমন নামের এক ভক্ত লিখেছেন, একটি লাইভ মিউজিক টিভি অনুষ্ঠানে বাচ্চু ভাই নিজে বলেছেন, এস আই টুটুল এলআরবি’র মেম্বার ছিল এবং থাকবে। আমি ওর জায়গা এখনও খালি রেখে দিয়েছি। তাই আমার মনেহয় এলআরবি’র অনেক গানও টুটুল ভাইয়ের গাওয়া আছে। তাই উনাকে আনার ব্যবস্থা করেন।
ব্যান্ড হিসেবে এলআরবি শক্ত অবস্থানে ছিলো আইয়ুব বাচ্চুর কারণে। তার বিস্ময়কর গিটার বাজানো আর উন্মাদনায় ভরা কণ্ঠে মেতেছে সবাই। এখন নতুন করে এলআরবি’কে জায়গা ধরে রাখতে হলে পুরো দলকে এক হয়ে থাকতে হবে
মিজানুর রহমান কাজল নামের আরেক ভক্ত লিখেছেন, দেশে অনেক ভোকাল আছে যারা বাচ্চু ভাইয়ের মতই কাছাকাছি গান গায়। তারপরেও এই বালামকে নিয়ে এলআরবি’র শ্রোতার মন নষ্ট করার যৌক্তিকতা নাই।
শুধু ভক্তরাই নয়, এলআরবি’র নতুন ভোকাল হিসেবে বালামের যোগদান মেনে নিতে পারছেন না সঙ্গীত সংশ্লিষ্ট অনেকেও। খ্যাতিমান গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলী তার ফেসবুকে লিখেছেন, বালাম তার নিজের গানগুলো ভালো গায়। কিন্তু এলআরবি’র জন্য বালাম ভুল সিলেকশন।
সঙ্গীতশিল্পী ও লেখক লুৎফর হাসান লিখেছেন, আর কখনো এলআরবি লাইভ শুনব না। তাদের জন্য শুভকামনা থাকবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আগের গানগুলোই শুনব। এই যে এলআরবি, এটা অন্য নামে আসতে পারতো।
জানা গেছে, এলআরবি’র ভোকাল হিসেবে বালামকে নেয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তিনি গিটার বাজাতে জানেন। দেশের অন্যতম গুণী গিটারিস্ট তিনি। যেহেতু আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম গিটারিস্ট, তার জায়গায় ভোকাল এবং গিটারিস্ট দুই দিক বিবেচনা করেই বালামকে যুক্ত করা হয়েছে।
এই বিষয় ভেবে অনেকে বালামকে ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। শুভকামনা জানিয়ে তারা সমর্থন করছেন এলআরবি’র নতুন এই রূপকে।
হৃষভ ইব্রাহীম নামের একজন লিখেছেন, পৃথিবীতে কেউ কারো রিপ্লেসমেন্ট না। তবে বালাম ভালো হবে আশা রাখি। কেউ যদি এবি’কেই খোঁজে তাহলে ভুল করবেন। গানগুলা বালাম বালামের মতই গাইবেন। বেস্ট অফ লাক এলআরবি।
মোরশেদ উদ্দিন আহমেদ নামের একজন লেখেন, এবি’র রিপ্লেসমেন্ট কাউকে দিয়ে সম্ভব নয়। তবে এই মুহূর্তে ব্যন্ডটাকে টিকিয়ে রাখতে বালাম ভাই খারাপ অপশন না। বাচ্চু ভাইয়ের সৃষ্টি টিকে থাকুক অনন্তকাল। শুভকামনা।
নাবিল তাজওয়ার নামে এক ভক্ত লিখেছেন, এলআরবি ব্যান্ডের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো। বালাম ভাইয়া আগে ওয়ারফেইজের ভোকাল ছিলেন; তিনি যখন ওয়ারফেইজ ছাড়লেন সেটা তার একটা বড় ভুল ছিলো। এবি তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তার শূন্যতা তো আমরা ভুলতে পারবো না। এখন এলআরবি’কে টেনে তোলার জন্য বালামকেই নেওয়াটা যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। এলআরবির জন্য অনেক শুভ কামনা।
ব্যান্ড হিসেবে এলআরবি শক্ত অবস্থানে ছিলো আইয়ুব বাচ্চুর কারণে। তার বিস্ময়কর গিটার বাজানো আর উন্মাদনায় ভরা কণ্ঠে মেতেছে সবাই। এখন নতুন করে এলআরবি’কে জায়গা ধরে রাখতে হলে পুরো দলকে এক হয়ে থাকতে হবে। যদিও শোনা যায়, এলআরবি’র বর্তমান সদস্যদের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। এসব কাটিয়ে যদি তারা মিলেমিশে থাকতে পারে, তাহলে টিকে থাকতে পারবে। কারণ নতুন এই এলআরবি’র কয়েকটি প্রতিপক্ষ রয়েছে। এলআরবি’র ভক্ত, পরিবার, গানের ঘরানা; এই প্রতিপক্ষগুলোর সঙ্গে লড়াই করে যেতে হবে নতুন এলআরবি’কে।
এছাড়া ব্যান্ড সঙ্গীতের সংগঠন বামবা থেকে এলআরবি নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। যদিও বামবা কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন গ্রহণ করেনি। তাই বামবা থেকেও এখন এলআরবি আশানুরূপ সমর্থন পাবে বলে মনে করছেন ব্যান্ড সঙ্গীত সংশ্লিষ্টরা।