রাজধানীতে সচিবালয়ও আগুনে নিরাপদ নয়

বিশেষ প্রতিনিধি

বাংলাদেশ সচিবালয় ভবন
বাংলাদেশ সচিবালয় ভবন। ফাইল ছবি


সচিবালয়ে থাকা ৯টি ভবনের মধ্যে ৪, ৬ ও ৭—এই তিনটি ভবন সবচেয়ে বড়। ৭ ও ৪ নম্বর ভবন দুটি নির্মাণ করা হয়েছিল ষাটের দশকে। এই তিনটি ভবনের সব কটিতেই বাইরের দিকে কোনো বারান্দা নেই।

বাংলাদেশ সচিবালয়ের সবচেয়ে বড় ভবনে (ভবন ৬) গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনা চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ বলেন, আমরা যে এখানে বৈঠক করছি, এই ভবনের তো কোনো বারান্দা নেই। আগুন লাগলে কী অবস্থা হবে?

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এমন আচমকা প্রশ্নে বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রী বা কর্মকর্তারা কেউ কোনো জবাব দিতে পারেননি। সবাই চুপ করে থাকেন।

ওই দিন মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন মন্ত্রীর দপ্তরে বসে তাঁর মুখ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রশ্ন এবং উপস্থিতদের নিরুত্তর থাকার ঘটনা শোনার পর কৌতূহল জাগে ভবনটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘুরে দেখার।

কারণ মাত্র তিন দিন আগেই বনানীতে ঘটে গেছে প্রাণঘাতী ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। সেই ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মন্ত্রী গত সোমবার আরো জানান, প্রধানমন্ত্রী সেদিনের বৈঠকে কড়া নির্দেশ দিয়ে বলেন, রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোতে অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে আইন প্রয়োগে কোনো রকম পিছপা হওয়া চলবে না।

এসব কথা শুনে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্রে অগ্নিনিরাপত্তার কী অবস্থা, স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ প্রবল হয়। পরের দিন সকালে সচিবালয়ের ভবন ৬-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চোখে পড়ে, ২১ তলা বিশাল ভবনটিতে কবুতরের খোপের মতো অসংখ্য ঘর শুধু, বারান্দা বলে কিছু নেই।


৪, ৬ ও ৭—এই তিনটি ভবন সবচেয়ে বড়

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সচিবালয়ে থাকা ৯টি ভবনের মধ্যে ৪, ৬ ও ৭—এই তিনটি ভবন সবচেয়ে বড়। ৭ ও ৪ নম্বর ভবন দুটি নির্মাণ করা হয়েছিল ষাটের দশকে। ৬ নম্বর ভবনটির নির্মাণকাল আশির দশকের শেষ দিকে। এই তিনটি ভবনের সব কটিতেই বাইরের দিকে কোনো বারান্দা নেই। দুই পাশে রুম, মাঝে চলাচলের রাস্তা। ৬ নম্বর ভবনের দুই পাশে ও মাঝে মিলিয়ে তিনটি সিঁড়ি থাকলেও একমাত্র মন্ত্রিপরিষদ ফ্লোর ও ২১ তলা ছাড়া আর কোনো ফ্লোরে ‘ফায়ার এক্সিট’-এর কোনো দিকনির্দেশনামূলক চিহ্ন চোখে পড়েনি।


প্রধানমন্ত্রীর অফিস ছাড়াও এই ভবনে মোট ১৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অফিস রয়েছে

আরো জানা যায়, বছরখানেক আগে ভবন ১ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সবচেয়ে বড় ২১ তলাবিশিষ্ট ভবন ৬-এ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও ক্যাবিনেট বৈঠক কক্ষ স্থানান্তর করা হয়। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অন্যান্য দপ্তর ভবন ১-এই আছে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ছাড়াও এই ভবনে মোট ১৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অফিস রয়েছে।

ভবন ৬-এর প্রতিটি ফ্লোরে ২৪ থেকে ৩০টি পর্যন্ত রুম আছে। একেকটি ফ্লোরের আয়তন ১৬ হাজার ৮৮৩ বর্গফুট। ফায়ার সার্ভিসের মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিটি ফ্লোরে অন্তত ১৬টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা প্রয়োজন। ভবনের ২১টি ফ্লোর ঘুরে প্রতিটিতে দেখা মিলেছে দুই থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি ফায়ার এক্সটিংগুইশারের। এর মধ্যে  চারটি মন্ত্রণালয়ের ফ্লোরে একটিও নেই। আগুন লাগলে ছাদে গিয়ে অবস্থান নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কারণ ছাদে ওঠার মতো কোনো সিঁড়িই নেই।


সাড়ে তিন শর বেশি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা প্রয়োজন

অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থায় প্রতি এক হাজার বর্গফুটের মধ্যে একটি করে হাতে বহনযোগ্য ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক আবদুল হালিম। এই হিসাবে ২১ তলা ভবনে সাড়ে তিন শর বেশি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা প্রয়োজন। সেই জায়গায় আছে ৬০টির মতো। আবদুল হালিম কিছুদিন আগে সচিবালয়ের বিভিন্ন ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা খতিয়ে দেখে ঘাটতি থাকা বেশ কিছু বিষয়ে সুপারিশ করেছেন বলেও জানিয়েছেন।

২১ তলা এই ভবনটিতে মোট ছয়টি লিফট ও তিনটি সিঁড়ি রয়েছে। লিফটের বাইরে মাঝখানের সিঁড়িটাই মূলত ব্যবহার করা হয়। ভবনটি কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, বাইরের দিকে বারান্দা না থাকায় ভেতরে আলো-বাতাস প্রবেশের একমাত্র পথ সিঁড়ির পাশে থাকা জানালাগুলো দিয়ে।


সিঁড়িঘরের বেশির ভাগ জানালাই বন্ধ থাকে

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সিঁড়িঘরের বেশির ভাগ জানালাই বন্ধ থাকে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে গিয়ে সিঁড়িতে যাওয়ার রাস্তায় কাচের অটো দরজা লাগিয়েছে, এতে একদিকে দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি বেড়েছে, সঙ্গে বাতাস প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে সাফোকেশন পরিস্থিতি তৈরি করছে।

২১ তলা ভবনের ১৩ তলায় প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও মন্ত্রিসভা বৈঠকের কক্ষ স্থানান্তরের পর বছরখানেক আগে সেখানে ‘ফায়ার হোসরিল’ (তাৎক্ষণিক পানি ছিটানোর পাইপ) বসানো হয়েছে, তা-ও ১৩ তলা পর্যন্ত। ভবনটি তৈরি হয়েছে প্রায় ৩০ বছর আগে।

ভবনের দায়িত্বে থাকা ইডেন গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী আনজুমান আরা ভূঁইয়া বলেন, মন্ত্রিপরিষদ কক্ষ আসার পরই এখানে হোসরিল লাগানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজের অধীনে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থাকলেও সচিবালয়ে গেলে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অফিসেই বসেন। নতুন অফিস হওয়া ২১ তলা এই ভবনের ছাদে যাওয়ারও কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।

ভবনটির এমন অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ২১ তলায় অফিস থাকা অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হাকিম উদ্দিন বলেন, আসলে বিষয়গুলো এমনভাবে আগে দেখা হয়নি। এখন বিভিন্ন জায়গায় আগুনের ঘটনার কারণে সামনে আসছে। আশা করি, দায়িত্বশীলরা ব্যবস্থা নেবেন।

এ বিভাগের অন্য একজন কর্মকর্তা তিন বছর ২১ তলায় অফিস করছেন, তাকে ছাদে যাওয়ার রাস্তার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি পথ বলতে পারেননি। এই ভবনে কোনো দিন ফায়ার ড্রিল হয়েছে এমন তথ্যও তাঁর জানা নেই বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা।

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনা চলাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হঠাৎ বলেন, আমরা যে এখানে বৈঠক করছি, এই ভবনের তো কোনো বারান্দা নেই। আগুন লাগলে কী অবস্থা হবে?


যেন কারও দায়িত্ব নেই!

সচিবালয়ের অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্বশীল সংস্থার খোঁজ নিতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে। ভবনগুলোর বারান্দায় থাকা ফায়ার এক্সটিংগুইশারের গায়ে গণপূর্ত বিভাগের (পিডাব্লিউডির) সিল-সাইন দেখা গেছে। এর সূত্র ধরে সচিবালয়ের গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলীর কাছে গেলে তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইডেন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তফা কামালের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ভবন ৪-এর পেছনে টিনশেডে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে গেলে তিনি বলেন, এটা গণপূর্তেরই দায়িত্ব, কিন্তু অন্য বিভাগ দেখে, সেটির নাম ইএম (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল) বিভাগ।

এরপর সচিবালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে থাকা ইএম বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী রুবাইয়াত ইসলামের কাছে গেলে তিনি বলেন, ইএম বিভাগের পক্ষ থেকে বৈদ্যুতিক বিষয়গুলো দেখা হয়। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসের।

এরপর আবারও ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল হালিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তার জন্য কোথায় কী দরকার সে বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অনুরোধ জানাই, নিরাপত্তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের।

সচিবালয় দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেপিআই (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন)। প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের আনাগোনা হয় এখানে। এখানে একটি পূর্ণাঙ্গ ফায়ার স্টেশনের চাহিদা আছে। ২০১৫ সালে দেশব্যাপী ‘আগুন সন্ত্রাস’-এর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অস্থায়ীভাবে ফায়ার ব্রিগেডের একটি টিম রাখা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেল, সচিবালয়ের অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন গণপূর্ত বিভাগও। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থাকা ভবন ৬সহ সব ভবনের আগুন ও সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দফায় দফায় মন্ত্রণালয়গুলোতে চিঠি দিচ্ছে ইডেন গণপূর্ত বিভাগ।

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে সব মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগে পাঠানো চিঠিতে সচিবালয়ের সব ভবনের সিঁড়িতে থাকা অব্যবহৃত আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য বলে দেয় ইডেন গণপূর্ত বিভাগ। সম্প্রতি বনানীর আগুনের পর আরেক দফা, বিশেষভাবে ভবন ৬-এর বিষয়টি উল্লেখ করে সতর্ক করা হয়। ইডেন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তফা কামাল সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে এভাবে চিঠি দিয়ে সতর্ক করছি। কিছু উন্নতি হয়েছে, আশা করি আরো হবে।

সচিবালয়ের অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, গণপূর্তের পক্ষ থেকে ভবনের কাঠামোসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখা হয়। আগুনের বিষয়টা ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের দায়িত্ব।

একই বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদসচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখব।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে