সোনাগাজী সিনিয়র ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার মূল হোতা অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলার যৌন হয়রানি ও নানা অপকর্মের কথা জানতেন মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা। তবে টাকার দাপটে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক চক্রকে ম্যানেজ করে চলতেন সিরাজ।
এই চক্রের ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পেতেন না শিক্ষক ও অভিভাবকরা। নানা সময়ে অভিযোগ করলেও ম্যানেজ হয়ে যেত প্রশাসন, উল্টো বিপদে পড়তেন অভিযোগকারীরা। গত কয়েক দিনে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য ও স্থানীয় জনগণের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
মাদ্রাসার তিন তলা মার্কেট, পুকুর, নানা অনুদান-তহবিল এবং ওয়াজ মাহফিল থেকে বছরে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন অধ্যক্ষ। অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের সুবিধার লোভ দেখিয়ে ভেড়াতেন নিজের দলে।
২০০১ সালে শতবর্ষী এই মাদ্রাসায় উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দেবার পর থেকে নানা সময়ে জেলা প্রশাসনের কাছে যৌন হয়রানি, অর্থ আত্মসাৎ ও হত্যার হুমকির মতো অভিযোগ জমা হয় তার বিরুদ্ধে।
তবে, মাদ্রাসার তহবিলের টাকা নয়ছয় করে অর্থের জোরে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ফেলতেন সিরাজ উদ দৌলা। সবশেষ গত ২৭ মার্চ নুসরাতকে যৌন হয়রানি এবং ৬ এপ্রিল আগুনে পোড়ানোর পরও চলেছে সেই টাকার খেলা।
যে কারণে শুরুর দিকে যৌন হয়রানির ঘটনাটিতে ষড়যন্ত্র ও আগুনে পোড়ানোকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এমনকি সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনও শুরুতে ঘটনাকে আত্মহত্যা বলেই উল্লেখ করেন। প্রায় দুই দশক ধরে যৌন হয়রানি, মাদ্রাসার টাকা আত্মসাৎ ও হত্যার হুমকির মতো অপরাধে অর্থের জোরে পার পেয়ে যায় সিরাজ উদ দৌলা।
গত বছরের ৩ অক্টোবর নুসরাতের আরেক বান্ধবীকে যৌন হয়রানি করেন সিরাজ। ওই ঘটনায়ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আক্তার উন নেছা শিউলির কাছে অভিযোগ দেয়া হয়। তবে নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির মতো ওই ঘটনায় শুধু একটি নোটিশ পাঠিয়ে দায় সারে জেলা প্রশাসন।
অভিযুক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। ওই শিক্ষার্থীর বাবা পূর্বধলী মদিনাতুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ঘটনার পর মেয়ে আমাদের কিছু জানায়নি। পরে বিষয়টি জানতে পেরে পরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্যকে বিষয়টি জানাই। ভয়ে আর জেলা প্রশাসনে কোন অভিযোগ দেইনি। তবে এর মধ্যে তার নামে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর একটি অভিযোগ জমা দেয়া হয়।
অভিযোগের পর অধ্যক্ষ সিরাজকে শোকজ করা হলে তিনি ক্ষেপে যান। অভিযোগের কারণে তিনজন শিক্ষককে উল্টো হেনস্তা করেন সিরাজ। তাদের ডেকে নিয়ে হুমকি দেয়া হয় এবং অপমান করা হয়। পরে আর জেলা প্রশাসন কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় আমরাও বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করিনি। শুনেছি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করায় প্রশাসন আর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
এদিকে, ২০১৬ সালে মাদ্রাসার তহবিলের অডিটে গরমিল ও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে পরের বছর অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি কে এনামুল করিমকে লিখিতভাবে জানান স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য শেখ আবদুল হালিম মামুন।
ওই বছর মাদ্রাসার বেশ কিছু তহবিল থেকে অধ্যক্ষ প্রায় ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ করেন শেখ মামুন। সেখানে দেখা যায়, ক্যাশ থেকে ৬ হাজার ২৬৫ টাকা ব্যাংকে জমা না দেয়া, মাদ্রাসার মার্কেটের দোকান ভাড়া ৪১ হাজার ১০০ টাকা, মাহফিলের অপ্রদর্শিত ১ লাখ ১১ হাজার ৬৯৩ টাকা, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭২৫ টাকা ব্যাংকে জমা না দেয়া, ক্যাশের ৯০ হাজার ২৯২ টাকা ব্যাংকে জমা না দেয়া, পরের মাসে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৮০৩ টাকা জমা না দেয়া, তহবিলের ৮৩ হাজার ২০০ টাকা ব্যাংকে জমা না রাখা, অভ্যন্তরীণ আয় ১ লাখ ১৮ হাজার ২৯৮ টাকা আত্মসাৎ করা, ছাত্র ফির ৬৮ হাজার ৭৫০ টাকা ব্যাংকে জমা না দেয়া, বছরের শেষের দিকে ক্যাশ থেকে আরো প্রায় ৫০ হাজার টাকাসহ মোট ২২ লাখ ৫২ হাজার ১০০ টাকা আত্মসাতের করেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন শেখ মামুন।
এসব প্রমাণ ছাড়ানো আরো কয়েকটি খাত থেকে ২০১৬ সালে সর্বমোট প্রায় ৫৬ লাখ টাকা অধ্যক্ষ সিরাজ নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন বলেও অভিযোগ ছিল শেখ মামুনের। তবে, এমন অভিযোগের পর তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পি কে এনামুল করিম অধ্যক্ষকে শুধু নোটিশ দিয়েই দায় সারেন।
অভিযোগের পর উল্টো পরের বছর পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয় শেখ আবদুল হালিম মামুনকে। তিনি বলেন, মাদ্রাসার তহবিলের টাকা আত্মসাৎ করার সুস্পষ্ট প্রমাণসহ অভিযোগ করলেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। পরের বছর বরং আমাকে পরিচালনা পর্ষদ থেকে ষড়যন্ত্র করে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল এসব টাকার ভাগ পেতেন। যারা অধ্যক্ষের হয়ে প্রশাসনের কাছে তদবির করতো।
সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, আর্থিক সুবিধা দিয়ে অধ্যক্ষ স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। অনেক অস্বচ্ছল ও গরিব শিক্ষার্থীদের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করতেন। পরে এদের নিজের দলে ভিড়িয়ে গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী।
এছাড়া, মাদ্রাসায় দুপুর ও রাতে লঙ্গরখানার মতো খানাপিনার আয়োজন করতেন অধ্যক্ষ। অনেকেই তার কাছ থেকে এসব সুবিধা নিতেন।নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ফেনী জেলা প্রশাসনের একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, ক্ষমতাসীন স্থানীয় রাজনীতিবিদদের প্রভাবে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাহর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি জেলা প্রশাসন।
অভিযোগের বিষয়ে কেন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি পি কে এনামুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সময়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে এডিএম আক্তারুন্নেছা শিউলির সময় একটি অভিযোগের কথা স্মরণ করেন। ওই শিক্ষার্থী ও তার পরিবারকে ডাকা হলে তারা বিষয়টি অস্বীকার করে বলে দাবি করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।
এছাড়া, অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয় বলেও জানান এনামুল করিম। কিন্তু সেই তদন্তে অর্থ আত্মসাতের কোন প্রমাণ মিলেনি বলেও দাবি করেন জেলা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা। তবে, পি কে এনামুল করিমের এমন বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে অভিযোগকারী শেখ আবদুল হালিম মামুন বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এমন কোন লিখিত কাগজ বা প্রমাণ আমাদের দেয়া হয়নি। মূলত তদন্ত না করেই অধ্যক্ষ সিরাজকে বাঁচিয়ে দিতে এমন ভূমিকা নেয়া হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
একই সাথে ২০১৮ সালে মাদ্রাসা থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সই জাল করে একটি চেক ইস্যু করা হয় বলেও জানান শেখ মামুন। এই ঘটনায় উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি বলেও জানান তিনি।
মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থাকাকালীন ২০১৭ সালে পুরো মাদরাসা এলাকা ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার আওতায় আনার দাবি তুলতে তা পর্ষদে পাস হয় বলে জানান শেখ মামুন। তবে, নিজের অপকর্ম ঢাকতে পরিচালনা পর্ষদকে ম্যানেজ করে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসাতে দেননি অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাহ। ওই বছর পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিসিটিভি ক্যামেরা বসালে নুসরাতের মতো আর কেউ যৌন হয়রানির শিকার বা আগুনে পুড়ে মারা যেতো না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার রহস্য উন্মোচন, মূল পরিকল্পনাকারী শনাক্ত ও আসামিদের গ্রেপ্তার করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে নুসরাতের পরিবারের সদস্যরা। পুরো কিলিং মিশন নিয়ে ধোঁয়াশা পরিষ্কার করায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) ধন্যবাদ জানান নুসরাতের বাবা এ কে এম মূসা। শনিবার দুপুরে নিহত নুসরাতের বাবা সাংবাদিকদের বলেন, সকলের প্রচেষ্টায় ঘটনার রহস্য উন্মোচন হয়েছে। আর বাকি আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার করার তাগিদ দেন নুসরাতের বাবা।
একই সঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেয়ার জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পিবিআই কম সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার ও হত্যার রহস্য উন্মোচন করায় তাদের ধন্যবাদ দেন নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। তিনি বলেন, আমি শুরু থেকেই বলেছি নূর উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করলে সব ঘটনা জানা যাবে। তবে শুরুর দিকে সোনাগাজী থানার ওসি ও প্রভাবশালী মহল আগুনে পোড়ানোর ঘটনাকে ভিন্ন অবস্থানে নেয়ায় তাদেরও শাস্তির দাবি করেন নুসরাতের ভাই।
এদিকে, মামলার আরো দুই আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম ও জাবেদ হোসেনকে গতকাল ময়মনসিংহ ও ফেনী থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। গতকাল বিকেলে এজাহারভূক্ত আসামি জাবেদ হোসেনকে ফেনী আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন বিচারক জাকির হোসাইন।