পহেলা বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম দিন। বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দিনটি নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। যে উৎসবে ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও অংশ নিয়ে থাকে। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের পহেলা বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি নতুন নিয়ম চালু করে। সেই থেকে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরু হয়। দিনটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত।
যতদূর জানা যায়, প্রাচীন কাল থেকেই খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে জমির মালিকরা হিসাবের একটি খাতা তৈরি করতেন। খাতায় খাজনা ও শুল্ক পরিশোধকারীদের নাম ও হালনাগাদ হিসাব লিখে রাখা হতো। যা পরবর্তীকালে ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত পায়। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। এই প্রথাটি আজও দেশজুড়ে প্রচলিত আছে, বিশেষ করে মুদি ও স্বর্ণের দোকানে।
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে। কিন্তু এতে করে তাদের কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। বিশেষ করে হিজরি সন চন্দ্রকেন্দ্রিক হওয়ায় প্রতিবছর তা কৃষি ফলনের মওসুমের সাথে মিলত না। যে কারণে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধে বাধ্য করা হতো। এক পর্যায়ে খাজনা আদায়ে সুষ্ঠু নিয়ম ও সময় নির্ধারণের লক্ষ্যে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে তার রাজস্ব কর্মকর্তা আমির ফতহেউল্লাহ সিরাজী ১৫৫৬ সালে উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখ পালনের নির্দেশ দেন। সেই থেকে প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। সেই উৎসবে খাজনা আদায় ও হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি চলত গান-বাজনা, গরু-মহিষের লড়াই, কাবাডি খেলা ও হালখাতা অনুষ্ঠান।
বাংলা নববর্ষের ‘পহেলা বৈশাখ’ এখন শহর, বন্দর, গ্রামগঞ্জে জাতি-বর্ণনির্বিশেষে আবালবৃদ্ধবনিতার হৃদয় নিংড়ানো উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি এক মহাখুশির দিন। পহেলা বৈশাখে বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয়, সুন্দর করে সাজানো হয়। গ্রাম ও শহরের বড় কোনো খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় মেলার। এসব মেলায় কত না বিচিত্র হাতের তৈরি দ্রব্যসম্ভার বিক্রি হয়। এসব দ্রব্যসামগ্রীতে ফুটে ওঠে বাংলার মানুষের বৈচিত্র্যময় জীবনধারার চিত্র। তাদের জীবন যেন খন্ড খন্ড হয়ে ধরা পড়ে শিল্পীদের হাতের কারুকাজে। মাটির পুতুল, পুঁতিরমালা, পাটের শিকা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, বাঁশের বাঁশি, ঝিনুকের ঝাড়, মাটির তৈরি হাতি-ঘোড়া-বাঘ-সিংহ কত যে অদ্ভুতসব সুন্দর জিনিসের সমাবেশ ঘটে সেই মেলায়। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এদিন গ্রামের মানুষ ইলিশ-পান্তা না জুটাতে পারলেও নিদেনপক্ষে কাঁচা মরিচ আর পান্তা খাওয়া থেকে বিরত থাকে না।
এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে কয়েকটি আকর্ষণীয় ঐতিহ্য হলো নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, কুস্তি ও জারি গান। মেলা শেষে রাতে বসে জারি গানের আসর। যে আসরে গ্রামের প্রায় সবাই ছুটে যায়। পহেলা বৈশাখ হালখাতা, বীজবপন, চড়কপূজা, গণেশপূজা, গাজন মেলা, সত্য পীরের গান, কেষ্টগান, পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা, মোরগ ও ষাঁড়ের লড়াই, যাত্রাপালা, জারিগান, গম্ভীরা, কবিগান, কবিতার আসর ইত্যাদিতে সারা বাংলায় খুশি ও মননশীলতার হিল্লোল বয়ে যায়। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজ গায়ক ও নর্তক-নর্তকীদের উপস্থিতি থাকে। একই সঙ্গে লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রাধা-কৃষ্ণ, রূপবান, সিরাজ-উদ-দৌলা প্রভৃতির উপাখ্যান উপস্থাপিত হয়ে থাকে। চলচ্চিত্র, নাটক, সার্কাস, ব্যান্ডশো, ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। আর ইদানীং যোগ হয়েছে গতিময় রঙিন লাইটিং, যা সহজে সবাইকে আকর্ষণ করে থাকে।
আজও পহেলা বৈশাখে ঈশা খাঁ’র সোনারগাঁয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। স্থানীয়ভাবে এটি ‘বটতলার মেলা’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া সোনারগাঁয়ে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ‘ঘোড়ামেলা’। লোকমুখে প্রচলিত- যামিনী নামের এক সাধক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে বাংলা নববর্ষের প্রথমদিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ওই স্থানে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়। নৌকায় খিচুড়ি রান্না করা এবং আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা ভোজন করা এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ। দেশের বিভিন্ন স্থানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে আয়োজন করা মেলার কোনোটি একদিন, তিনদিন, আবার কোনোটি সপ্তাহব্যাপী চলে। এক সময় পারস্পরিক ভাব বিনিময়, সম্প্রীতি ও ক্রয়-বিক্রয়ের উৎস হিসেবে উদযাপিত হতো এসব মেলা। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ সারা বছরের প্রয়োজনীয় উপকরণ বৈশাখী মেলা থেকেই কিনত।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে যে মেলার প্রভাব ছিল ব্যাপক। সেই মেলায় বিভিন্ন দ্রব্যাদি বিশেষ করে হাতের তৈরি কুটির শিল্পের নানা জিনিস যেমন- চেয়ার, টেবিল, চৌপায়া, ব্যালন, পিঁড়ি, রেহেল, লাঠি, ইঁদুর ধরার ফাঁদ, কুলা, নারকেল কোরানি, গাঁইল, চেগাইট, খড়ম, বাঁশের বাঁশি, পাউডি, ডাল ঘুটনি, ঘুড়ির নাটাই, পাটের শিকা, তালপাতার পাখা, সোলার পাখি, ঝিনুকের ঝাড়, মাটির তৈরি পুতুল, পুঁতিরমালা,হাতি-ঘোড়া-বাঘ-সিংহ, মুড়ি, মন্ডা, মিঠাই, জিলাপি, বাতাসা, তিলের খাজা, তেজপাতাসহ শত ধরনের অদ্ভুতসব সুন্দর জিনিসের সমাবেশ ঘটে। এককথায়, শিল্পের এক বিশাল সমাবেশ ঘটত এসব মেলায়।
ঢাকায় ছায়ানটের শিল্পীরা এদিন ভোরে সম্মিলিত কণ্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানান। ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানট এই অনুষ্ঠানের সূচনা করে। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের আরেকটি আবশ্যিক অঙ্গ হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে এটি বের হয়। এতে ফুটিয়ে তোলা হয় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে। ১৯৮৯ সাল থেকে এটি পহেলা বৈশাখ উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে আমাদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’কে ইউনেস্কো ২০১৬ সালে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা বা ইনট্যানজিবল (Bs: Intangible) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
পহেলা বৈশাখ শুধু উৎসব নয়, নতুন করে জেগে ওঠার দিন। সমাজের সকল অন্যায় অসাম্য ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠার নতুন শপথ নেওয়ার দিন। এদিনে ধুলো পড়া অতীত পিছনে ফেলে নতুন স্বপ্ন বুনবে বাংলার কৃষক।