সিরাজ-উদ-দৌলা এখনও জামায়াত নেতা

সারাদেশ ডেস্ক

অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা
অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা। ফাইল ছবি
ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যার পর একে একে বেরিয়ে আসছে অনেক তথ্য। অধ্যক্ষ ও প্রশাসনের অনিয়ম-দুর্নীতি, জেলার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, রাজনৈতিক নেতাদের দুর্বৃত্তায়নসহ নানান বিষয় এখন সামনে এসেছে। সোনাগাজীসহ পুরো ফেনীতে এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। তবে সব ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও জামায়াত নেতা সিরাজ-উদ-দৌলার অপকর্ম।

মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, অভিভাবক কমিটির সদস্য ও স্থানীয় রাজনীতিবিদরা জানান, আশির দশকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিতে সক্রিয় হন সিরাজ। পরে জামায়াতের রোকন হন। ২০১৬ সালের দিকেও তাকে জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে দেখা যেত। পরবর্তী সময়ে জামায়াতের সভা-সমাবেশে তাকে দেখা না গেলেও দলের জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এতকিছুর পরও জামায়াত থেকে এখনও সিরাজকে বহিস্কার করা হয়নি। এমনকি উপজেলা জামায়াতের বড় একটি অংশ এখনও তার পক্ষে কাজ করছে।

এ বিষয়ে উপজেলা জামায়াতের আমির কলিম উল্যাহ বলেন, সিরাজকে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৬ সালে জামায়াত থেকে বহিস্কার করা হয়। জামায়াতের সঙ্গে এখন তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাকে বহিস্কারের কোনো কাগজ কিংবা প্রমাণ দেখাতে পারেননি তিনি। কলিম উল্যাহ আরও বলেন, জামায়াত কখনোই লিখিতভাবে বহিস্কারাদেশ দেয় না। মৌখিকভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জামায়াতের একটি পক্ষ এখনও সিরাজের পক্ষে কাজ করছে বলে যে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে উপজেলা জামায়াতের আমির বলেন, এটি সত্য নয়। অধ্যক্ষ জেলে যাওয়ার আগেও জামায়াতের নেতাকর্মীদের দেখলে তিনি গালি দিতেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন।

universel cardiac hospital

অধ্যক্ষের পক্ষে কাজ করতে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ: নুসরাতকে শ্নীলতাহানির মামলায় সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ যখন জেলে, তখন তার স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেন-দরবার শুরু করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফেরদৌস আক্তার এ জন্য নানা মহলকে টাকা দিয়েছেন বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে।

 তার বোন হোসনে আরা বেগমের মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর বাড়িতে গিয়ে তার বিষয়ে কোনো তথ্য মেলেনি। হোসনে আরা বেগমের স্বামী সহিদুল ইসলাম বলেন, অধ্যক্ষের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার এখন কোথায় থাকেন, তারা জানেন না। সোনাগাজীর ৮নং আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরকৃষ্ণজয় গ্রামে অধ্যক্ষ সিরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার ঘরে তালা। বাড়ির সামনে পুলিশ পাহারা বসানো হয়েছে। অধ্যক্ষের স্ত্রী ও ছেলেরা এখন কোথায় আছেন, তা জানেন না সিরাজের বড় ভাইয়ের স্ত্রী হাছিনা আক্তার।

অধ্যক্ষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অনুসন্ধান করে দেখা যায়, তার একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে জনতা ব্যাংকের সোনাগাজী শাখায়। ওই ব্যাংকের ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম বলেন, এখানে অধ্যক্ষের শুধু বেতন-ভাতার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তিনি গ্রেফতারের পর থেকে এই অ্যাকাউন্টে কোনো লেনদেন হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অধ্যক্ষের স্ত্রীর কাছে রক্ষিত টাকা তিনি প্রথমে স্বামীর মুক্তির আন্দোলন, পরে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার কাজে ব্যয় করেন। আর সিরাজের নির্দেশেই এ টাকা তিনি ব্যয় করেছেন।

আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্যে: নুসরাত হত্যার ঘটনার সঙ্গে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজনের নাম জড়িয়ে পড়ায় বিব্রত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অবস্থানে স্থানীয় নেতৃত্বের বিরোধ প্রকাশ্যে উঠে এসেছে। নেতারা এখন একে অন্যের সমালোচনায় ব্যস্ত। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে বিপর্যস্ত স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়েও রয়েছে ধূম্রজাল। নেতাকর্মীরা বলছেন, জেলা কমিটি রুহুল আমিনকে সভাপতি ঘোষণা করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়নি। আবার আগের সভাপতি ফয়জুল কবিরকে অব্যাহতি না দেওয়ায় তিনি এখনও নিজেকে সভাপতি বলেই দাবি করেন। জেলার প্রভাবশালী নেতাদের পছন্দে পকেট কমিটি নিয়ে ইচ্ছামতো দল চালাচ্ছেন রুহুল আমিন।

নুসরাতকে যৌন হয়রানির ঘটনার পর রুহুল আমিনসহ মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটিতে যুক্ত একটি পক্ষ প্রকাশ্যে ও গোপনে অধ্যক্ষ সিরাজকে রক্ষায় মাঠে নামে। অন্যপক্ষ সিরাজের বিচারের দাবিতে সক্রিয় হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ আবদুল হালিম মামুন বলেন, আমরা চেয়েছিলাম নিপীড়ক অধ্যক্ষের বিচার করতে। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন এবং পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম আমাদের আন্দোলন করতে বাধা দিয়েছিলেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিন বলেন, আমি কাউকে মদদ দিইনি। আমিও অপরাধীদের কঠোর বিচার চাই।


ম্যাজিস্ট্রেটের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে তোলাপাড়: ১৯৯৬-২০০১ সালে জয়নাল হাজারীর প্রতাপের কথা ভোলেনি এই জেলার মানুষ। তারপর ২০১৪ সালে শত শত মানুষের সামনে ফেনীর একাডেমি রোডে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরামকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে এসে আবারও আলোচনায় ফেনী।

ফেনীর তৎকালীন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানার একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে এখন তোলপাড় চলছে। তিনি প্রকাশ করেছেন- কাদের ছত্রছায়ায় ফেনীর সন্ত্রাসীরা লালিত-পালিত হয়। সন্ত্রাসীদের মূল খুঁটিতে কারা? সন্ত্রাস থেকে দায়মুক্তি হতে সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীরও।

সোহেল রানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষা নিচ্ছেন। নুসরাত হত্যার পর গত ১১ এপ্রিল তিনি ফেনী জেলার মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ অপরাধী চক্র, পুলিশ প্রশাসনের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে কয়েকটি স্ট্যাটাস দেন তার ফেসবুক পেজে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, ‘ফেনীতে এদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না। আপনি খতিয়ে দেখুন, দুর্নীতিবাজ অফিসারদের নিয়ে এদের আস্টম্ফালন কী দানবাকৃতির। যদি আমি ভুল হই তবে আমাকে চাকরিচ্যুত করুন। আর যদি আমি ঠিক হই, আপনি রক্ষা করুন ফেনীকে। দয়া করে জিজ্ঞেস করুন, মাদক তালিকায় যারা শীর্ষে তাদের বিরুদ্ধে কেন কোনো অভিযান নেই?’

এ বিষয়ে ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, সোহেল রানা ফেনীতে যখন ছিলেন, তখন এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করতে গিয়ে একাধিকবার তিনি হামলারও শিকার হয়েছেন। ফেনীতে অপকর্ম করতে গিয়ে বেশিদিন সুবিধা করতে না পারায় তিনি এখন এসব অপপ্রচার করছেন।

নিজাম হাজারী বলেন, অতীতের সব সময়ের চেয়ে ফেনী এখন অনেক ভালো আছে। এখানে শান্তির সুবাতাস বইছে। মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের ঘটনায় শক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন জানিয়ে এ সাংসদ বলেন, আমার নির্দেশেই পুলিশ মামলা নিয়েছে ও অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করেছে। এ ঘটনায় আমি কাউকে প্রশ্রয় দেব না। নুসরাতের মামলা চালাতে যত খরচ লাগে সব আমি দেব। নুসরাতের নামে একটি সড়কও নামকরণ করা হবে বলে জানান তিনি।

এসব বিষয়ে জানতে সোহেল রানাকে ফেসবুকে মেসেজ দিলে তিনি জবাবে বলেন, ‘আমি যে অপকর্ম করেছি তার একটা উদাহরণ এমপিকে দিতে বলুন। এমপি নিজাম হাজারী মাদক ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তার সবচেয়ে কাছের লোক জিয়াউল আলম মিস্টার। তিনি তিন তালিকাতেই ফেনীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী। এমপির উদ্বোধন করা অবৈধ গ্যাসের লাইন বিচ্ছিন্ন করায় তার মন খারাপ। আমার জাস্ট একটা অপকর্ম তিনি প্রমাণ করতে পারলে চাকরি ছেড়ে দেব।’

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে