অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য। তবে সপ্তাহের দুই দিন তিনি ক্লাস নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা শিক্ষা বিভাগে। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হওয়ায় মাসে অন্তত দুইবার বরির গাড়ি নিয়ে সেখানে যাতায়েত করেন।
এ ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র মডারেশন ও নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। এর বিনিময়ে তিনি সব যায়গা থেকেই নিয়মিত থাকা ও খাবারের (টিএ/ডিএ) পাশাপাশি ও সন্মানীভাতা নিয়ে থাকেন। তার পরেও ঢাকায় বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের অজুহাত দেখিয়ে প্রতিমাসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার টাকার টিএ/ডিএ তুলে নিচ্ছেন।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক ২০১৭ সালের অক্টোবরে টিএ/ডিএ বাবদ ৩২ হাজার ৮৩০ টাকা তুলেছেন। ওই মাসে তিনি স্নাতক শ্রেণির ভর্তিও পরীক্ষার গোপনীয় কাজ সম্পাদনের জন্য ঢাকায় ১২ দিন অবস্থান করেছেন। খাবারবাবদ ২১ হাজার ৮৪০ নিয়েছেন। অথচ ঢাকাস্থ লিয়াজোঁ অফিসের সকল খাবারের খরচ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
এ ছাড়াও ভর্তি পরীক্ষার পুরো কাজ কাজের টাকা ভর্তি পরীক্ষার টাকা থেকেও নিয়েছেন। ওই বছরের পরীক্ষার হিসাব বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দেওয়ায় এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একইভাবে তিনি গত বছরের জানুয়ারিতে ৫৬ হাজার ৭১২ টাকা টিএ/ডিএ তুলেছেন।
ছোট কেনাকাটা বড় অনিয়ম
রসায়ন বিভাগের ল্যাব স্থাপনের জন্য পানি ও গ্যাসের লাইনের জন্য ২০১৭ সালের ২০ জুলাই আলাদা আলাদা কোটেশন দাখিল করা হয়। বিলটি যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, যারা কোটেশন দাখিল করেছেন তারা সকলেই সরবরাহকারী। দাখিলকৃত কোটেশনে কোনো তারিখ নেই। ওই কাজের জন্য তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি ছিল না বৈধ ও হালনাগাদ কোনো কাগজপত্র। আলাদা কোটেশন দাখিল করা হলেও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি দুটি কাজকে একাত্রিত করে কার্যাদেশ প্রদান করেছেন। ওই বছরের ৩ আগস্ট উপাচার্যের অনুমোদনসাপেক্ষে সরকারি ক্রয়নীতি ভেঙে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিল দাখিলের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আলাদা আলাদা ভাবে দাখিল করেছেন।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরিশাল সদর উপজেলার জাগুয়া ইউনিয়নের মেসার্স ইসাম বিল্ডার্স। প্রপাইটার মো. সাইদুল করিম। ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট ১৫৯ নম্বর ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে তিনি বিল দাখিল করেছেন। রসায়ন বিভাগের ল্যাবের ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৯ টাকা ব্যয়ে সিভিল ওয়ার্কের কাজ করেছে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেখানে ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই ১৫৬ নম্বর ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে বিল দাখিল করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুটি লাইসেন্সই ভুয়া। মো. সাইদুল করিম মূলত এলজিইডির তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদার।
রসায়ন বিভাগের ল্যাবে ২ লাখ ২১ হাজার ৬৫৮ টাকা ব্যয়ে কাঠের কাজ পেয়েছেন ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারুলতা ইনটেরিয়ার ডেকোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক ইস্যুকৃত (১০৭১৮৯) ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিল দাখিল করে। তবে হিসাব শাখা থেকে একই বছরের ২০ মার্চ আপত্তি দাখিলের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তড়িঘড়ি করে উক্ত লাইসেন্সটি নবায়ন না করে একই নামে বাকেরগঞ্জ পৌরসভা থেকে ওই বছরের ১৬ এপ্রিল একটি ট্রেড লাইসেন্স জমা দেয়।
কাঠের কাজের ওই বিলটি যাচাই করে আরো দেখা যায় যে, ইয়াসিন স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাঠের কাজটি করার জন্য ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩১২ টাকার একটি কোটেশন দাখির করেছে। যার ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসায় ধরন চায়ের দোকান উল্লেখ রয়েছে।
বিলটি নিয়ে হিসাব শাখা আপত্তি দাখিলের পরও ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি উপাচার্য বিলটির অনুমোদন দিয়েছেন। একই ভাবে পদার্থবিজ্ঞান, মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান, গণিত, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা, কম্পিউটার সায়েন্স, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে স্থাপিত ল্যাবেও সরকারি ক্রয়নীতি অনুসরণ না করে লাখ লাখ টাকার কার্যাদি সম্পন্ন করা হয়েছে।
অর্থ ও হিসাব শাখার উপপরিচালক সুব্রত কুমার বাহাদুর বলেন, টিএ/ডিএ বিল একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। উপাচার্য মহোদয় যথযথ কাগজ জমা দিয়েই বিল তোলেন। তা ছাড়া উপাচার্য মহোদয় বিল দিলে তা পরিশোধ করতে আমরা বাধ্য। সরকারি ক্রয়নীতি অনুসরণ করে ২৪টি বিভাগের সকল কাজ করা সম্ভব নয়। এ কাজ করতে গিয়ে আমাদেও কিছু ভুল হতে পারে। তবে সেই ভুল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই আমরা করতে বাধ্য হচ্ছি।
এক গাড়ি, তিন চালক
মোহাম্মদ শাহ জালাল ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর ড্রাইভার পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কেউ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেননি। আর দেখবেনই কীভাবে? তিনি উপাচার্যেও ড্রাইভার হিসেবে নিয়োগ পেলেও ঢাকায় তার স্ত্রীর গাড়ি চালান। এখানে শেষ নয়। উপাচার্যের ড্রাইভার হিসেবে আরো দুজন চাকরি করছেন। ড্রাইভার শাহীন শিকদার বরিশালে গাড়ি চালান। আর ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসে মো. তোফায়েল হোসেন। এভাবেই একটি গাড়ি কাগজপত্রে তিনজনে চালাচ্ছেন।
যদিও উপাচার্য নিয়মিত আকাশপথে ঢাকা-বরিশাল যাতায়াত করেন। কিন্তু তার ব্যবহৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাজেরো গাড়িটি জ্বালানি পুড়িয়ে খালি অবস্থায় আসা-যাওয়া করে। পাশাপাশি উপাচার্যের তিনজন গাড়িচালকের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের বেতন, অতিরিক্ত দায়িত্বভাতা এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে এ টাকা নিচ্ছেন। অতিরিক্ত অর্থের এই অপচয়ের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরেও অপচয়রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
পরিবহন পুলের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মেহেদী হাসান বলেন, উপাচার্য এবং প্রকল্প পরিচালকের জন্য দুটি গাড়ি বরাদ্দ রয়েছে। উপাচার্যেও গাড়িটি অধিকাংশ সময় ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসে থাকে। তখন উপাচার্য মহোদয় প্রকল্প পরিচালকের গাড়িটি বরিশালে ব্যবহার করেন। ড্রাইভার মোহাম্মদ শাহ জালালের ব্যাপারে মেহেদী হাসান বলেন, উপাচার্য ব্যাক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি পাবেন। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে আগেভাগেই তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক শাহ জালালকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জালাল ঢাকাতেই উপাচার্যের ব্যক্তিগত গাড়ি চালান।