এক বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার খবর নিছক প্রোপাগান্ডা বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। প্যারোলের নামে মাইনাস তত্ত্বের অশুভ চক্রান্ত করে লাভ হবে না বলে হুশিয়ারি দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
রিজভী বলেন, এ প্রোপাগান্ডাগুলোর সঙ্গে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জড়িত বলে গুঞ্জন রয়েছে। খালেদা জিয়া প্রচণ্ড অসুস্থ, কিন্তু তা নিয়ে মিডিয়াগুলো নীরব। প্যারোল নিয়ে সরকারি মিশন সফল করার জন্য ক্ষমতাসীনরা চতুর রাজনীতিতে লিপ্ত রয়েছে।
বিএনপির এ নেতা বলেন, গত কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন মিডিয়ায় সূত্রবিহীন একটি খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে যে, তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্যারোলে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন, এমনকি তারা তারিখও বলে দিচ্ছেন! কিন্তু বাস্তবতা হলো- বিএনপির কোনো সূত্র এমন কিছুই জানে না। অথচ সরকারপন্থী কয়েকটি মিডিয়া প্রতিদিন মনগড়া প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রোপাগান্ডাগুলোর সঙ্গে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও জড়িত বলে ব্যাপক গুঞ্জন আছে।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে রিজভী বলেন, তিনি শারীরিকভাবে খুবই বিপর্যন্ত। হাত-পা নাড়তে পারছেন না। আর্থ্রাইটিসের ব্যথার কারণে পা নাড়াতে পারছেন না। তাকে সুচিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। গতকালও চিকিৎসকরা বলেছেন, তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এ অবস্থায় দেশনেত্রী চাচ্ছেন তার পছন্দমতো বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু এই অবৈধ সরকার তার জীবন হুমকির মুখে ফেলে সুদূরপ্রসারী স্বার্থসিদ্ধির ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে।
খালেদা জিয়ার দ্রুত মুক্তি দাবি করে বিএনপির এই নেতা বলেন, আইনজীবীরা বলেছেন, তাকে যে মিথ্যা সাজানো মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে অন্যায়ভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে, তা সহজ জামিনযোগ্য। আইনি প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক পথে জামিনে মুক্তি চান তিনি।
খালেদা জিয়াকে হত্যা করে সরকার মাইনাস ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চাইছে দাবি করে রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বলব- দেশনেত্রীকে নিয়ে মাইনাস ফর্মুলা বন্ধ করুন। ওয়ান ইলেভেনের সরকার মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জনগণের প্রাণপ্রিয় দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার আপসহীন কঠোর ভূমিকায় তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। তারা সফল হলে আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। প্যারোলের নামে মাইনাস তত্ত্বের অশুভ চক্রান্ত করে লাভ হবে না। তার জামিনে আর বাধা দেবেন না। আদালতে হস্তক্ষেপ বন্ধ করুন। আদালতের উপর থেকে অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ হলেই আমাদের নেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে বেরিয়ে আসবেন। আইনকে তার নিজের গতিতে চলতে দিন। অপতৎপরতা বন্ধ না করলে আখেরে আপনাদেরকে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে। পরের জন্য গর্ত খুড়লে নিজেকেই সেই গর্তে পতিত হতে হয়-এটা কেবল প্রবাদ নয় বাস্তব। সুতরাং দেশনেত্রী ও বিএনপি-কে নিয়ে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র বন্ধ করুন।
আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণ ক্ষিপ্ত মন্তব্য করে বিএনপির এ নেতা বলেন, আপনাদের প্রতি দেশের জনগণ এমনিতেই চরম ক্ষিপ্ত। চক্রান্ত করলে জনগণ উপযুক্ত জবাব দেবে। আমি আবারও দৃঢ়কন্ঠে বলতে চাই-অবিলম্বে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসা ও নি:শর্ত মুক্তি দিতে হবে।
সরকার দেশ চালাতে ব্যর্থ এমন মন্তব্য করে রিজভী বলেন, মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতার মসনদ দখলে রাখা অবৈধ সরকার দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের লাশের ওপর দেশ চালাচ্ছেন। তাই কোনো কিছুই এখন যেন তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। দেশে চলছে এক চরম নৈরাজ্য এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি। দেশে কোনো সরকার আছে বলে অনুমিত হচ্ছে না। খুন-ধর্ষণ-লুটপাটে মত্ত হয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। পুলিশ প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা রাতের ভোটে ব্যালটবাক্স ভরে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন, তারাও বেপরোয়া হয়ে গেছেন। সরকারকে পরোয়া করছে না। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। প্রতিদিন প্রাত্যহিক খবরের কাগজগুলোর পাতা ভরে থাকছে খুন-ধর্ষণ, পাশবিক নিপীড়নসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায়।
দেশে ধর্ষণের উৎসব চলছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, দেশে যেন ধর্ষণের উৎসব চলছে। নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। শিশু-কিশোরী কিংবা বয়স্ক নারী কেউ নিরাপদ নন। প্রতিদিনই শিশু-কিশোরী ও বয়স্ক মহিলারা বর্বরতার শিকার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, পাশবিক নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হচ্ছে। গণপরিবহনে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে কিংবা বাসাবাড়িতে, রাস্তাঘাটে সর্বত্রই নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছেন।
ফেনীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার বিচার দাবি করে রিজভী বলেন, যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। সেখানকার অন্ধকারের ভোটের এমপি থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এবং পুলিশের সহযোগিতায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ওলামা লীগ নেতা সিরাজউদ্দৌলা অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছিল দিনের পর দিন। অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রুহুল আমিনের জ্ঞাতসারে পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের টাকায় ছাত্রলীগ সভাপতি শাহাদত হোসেন শামীম ও ছাত্রলীগ নেতা নুরুদ্দিনের সক্রিয় অংশগ্রহণে সরকারি দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থাকা প্রভাবশালীরা পরিকল্পিতভাবে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটেছে। এরা কতটা বেপরোয়া এবং শক্তিশালী যে, খুনির পক্ষে প্রকাশ্যে মিছিল করে হুমকি পর্যন্ত দেয়।
তিনি বলেন, পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে- ফুলগাজীর উপজেলা চেয়ারম্যন একরামকে যার নির্দেশে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সেই বিনাভোটের এমপির লোকজন নিয়ে নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে মামলা তোলার জন্য চাপ দিচ্ছে। এর পরেই নুসরাতের পরিবারকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী ধরিয়ে দিলেন একটি ব্যাংকের নিয়োগপত্র। জনমনে ধারণা, দলীয় নেতাকর্মীদের বাঁচানোর সনদই হচ্ছে এই নিয়োগপত্র। যাতে করে পরিবারটিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মামলার গতিবদল করা যায়।
সোনাগাজী থানার ওসির বিচার দাবি করে রিজভী বলেন, নয় দিন হলো নুসরাত মারা গেছেন। অথচ এই দুষ্কর্মের সহযোগিতাকারী সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি। যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর নুসরাত জাহানকে ডেকে নিয়ে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে লাঞ্ছিত করে, সেই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেও তার কোন বিচার হচ্ছে না।