তিন প্রকল্পে বদলে যাবে রাজধানী ঢাকার চিত্র

ডেস্ক রিপোর্ট

রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে দ্রুত এগিয়ে চলছে মেট্টোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, র‌্যাপিড ট্রানজিট বাস সার্ভিস প্রকল্পের কাজ। এই তিন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থা একদিকে যেমন সহজ হবে, অন্যদিকে দুঃসহ যানজট থেকেও নগরবাসী মুক্তি পাবে। বদলে যাবে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা।

রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে বর্তমান সরকার একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে মেট্টোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে, র‌্যাপিড ট্রানজিট বাস সার্ভিস অন্যতম। অগ্রাধিকারভিত্তিক সবগুলো প্রকল্পের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। চলতি বছরের শেষে জনগণ এর সুফল পাবে।


মেট্টোরেল প্রকল্প

আগামী ডিসেম্বরেই রাজধানীতে দেশের প্রথম মেট্টোরেলের যাত্রা শুরু হবে। এই প্রকল্পের ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ। উত্তরার দিয়াবাড়ি অংশে অবকাঠামো প্রায় ২ কিলোমিটার দৃশ্যমান। এই অংশে রেলের ট্র্যাক বসানোর প্রস্তুতি চলছে। রাজধানীর যানজট নিরসনে ২০ বছর মেয়াদি সংশোধিত পরিবহন কৌশল পরিকল্পনা (আরএসটিসি) অনুযায়ী রাজধানীর সঙ্গে মোট ৫টি মেট্টোরেলের রুট নির্মাণ করা হবে। এরমধ্যে প্রথমটি হচ্ছে এমআরটি-৬।

প্রকল্প পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক জানান, কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। পুরো প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। তবে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম অংশের কাজ শেষে মেট্টোরেল চলাচল শুরু করবে। প্রকল্প অবকাঠামোর দৃশ্যমান ২ কিলোমিটারে সেগমেন্ট বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই রেললাইন বসানো হবে। সেগমেন্ট তৈরি আছে। আগামী জুন-জুলাইয়ে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে।


ঢাকা ম্যাস-ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) প্রকল্পের আওতায় ৮টি প্যাকেজে মেট্টোরেল নির্মাণের কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ইতাল-থাই ডেভলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেডের দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছেন। প্যাকেজ-৩ ও প্যাকেজ-৪ এর আওতায় উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রকল্পের প্রথম অংশের নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। পুরো প্রকল্পে মোট ৭৬৬টির মধ্যে ইতোমধ্যেই সাড়ে তিনশ পাইলক্যাপের কাজ শেষ। ১৩০টি পিয়ার দৃশ্যমান। আরো ৩২৭টি পাইলিং হয়েছে। এগুলোতেও দ্রুত পিয়ার জেগে উঠবে। এ ছাড়া মোট ৪৪৮টি পিয়ার হেডের মধ্যে ৮৮টি এবং ৪ হাজার ৫৭৭টি প্রিকাস্ট সেগমেন্টের মধ্যে ৬১৭টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

উত্তরার দিয়াবাড়িতে ৬০ একর জমিতে মেট্টোরেলের ডিপো হবে। সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অপারেশন কন্ট্রোল টাওয়ার, প্রধান ওয়ার্কশপ নির্মাণ, স্ট্যাবলিং ইয়ার্ড, ট্রেন মেরামত ও ওভারহলের মালামালের গুদামঘর নির্মাণকাজ চলছে। এ ছাড়া ট্রেন মেরামত ও ওভারহোল স্থান, ট্রেন ইন্সপেকশন, জেনারেটর ও ইলেকট্রিক্যাল ভবন, ট্রেন ওয়াশ স্থাপনা, ম্যানুয়াল ট্রেন ওয়াশিং, বহুতল কার পার্কিং ও গ্রিন স্পেসের কাজও চলছে। অন্যদিকে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের পিলার তৈরির পাইলিং চলছে। পাশাপাশি ফার্মগেট থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন স্থানে মেট্টোরেলের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।


জাপানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘কাওয়াসাকি মিৎসুবিশি কনসোটিয়ামের’ নিজস্ব কারখানায় মেট্রোরেলের অত্যাধুনিক কোচগুলো তৈরি হচ্ছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচগুলো স্টিলের তৈরি। এতে উভয় পাশে লম্বা সিটে বসে ও দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ১ হাজার ৭৩৮ জন যাত্রী চলাচল করতে পারবে। অসুস্থ, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধীদের জন্য দুটি হুইল চেয়ার থাকবে। প্রতিটি কোচে ৪টি করে স্বয়ংস্ক্রিয় দরজা থাকবে।


কোচগুলো যাত্রী ওঠানামার পর ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে। উত্তরা থেকে ৩৫ মিনিটে মতিঝিল পৌঁছবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনে যাত্রী উঠানামা করাবে। স্টেশনগুলো হলো উত্তরা-উত্তর, উত্তরা-সেন্টার, উত্তরা-দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল। মেট্টোরেলের ট্র্যাক নির্মাণ শেষ হলে কোচগুলো লাইনে বসানো এবং এরপর বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে।


এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

২০২১ সালের মধ্যেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হবে। এটি চালু হলে রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে কম সময়ে যাতায়াত করা যাবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আসবে। তিন অংশে বিভক্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশে বিমানবন্দর থেকে বনানী, দ্বিতীয় অংশে বনানী থেকে মগবাজার এবং তৃতীয় অংশে মগবাজার থেকে কুতুবখালীতে গিয়ে কাজ শেষ হবে। চলতি বছরেই বনানী পর্যন্ত চার লেন বিশিষ্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম অংশের কাজ শেষ হবে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ মগবাজার পর্যন্ত এবং ২০২১ সালের শেষ নাগাদ পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।


সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যেই প্রথম অংশের ৫০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। এখন এক পিলার থেকে অপর পিলারের সংযোগের কাজ শুরু হয়েছে। পিলারের ওপর ক্যাপ বসানো হয়েছে। আই গার্ডার বসানোর কাজ চলছে। তারপরেই একটার পর একটা স্ল্যাব বসিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের পথ তৈরি হবে। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সাড়ে ১২০০ পাইল ও ১৬০টি কলাম সম্পূর্ণ প্রস্তুত আছে। ইতোমধ্যেই পিলারগুলোর ওপর ২৭৪টি পাইলক্যাপের ওপর আই গার্ডার বসানো শুরু হয়েছে।


এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম এস আকতার জানান, প্রকল্পের প্রথম অংশে বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত সাড়ে ৭ কিলোমিটার এলাকায় পিলার উঠে গেছে। বেশিরভাগ পিলারে ক্যাপ বসানো হয়েছে। আই গার্ডার বসানো হচ্ছে। এই অংশের কাজ আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে।


এই এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হলে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রায় ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার পথ ২৫ থেকে ৩০ মিনিটেই অতিক্রম করা সম্ভব হবে। বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত প্রথম অংশের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার, বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার এবং মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত শেষ অংশের দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৮০ হাজার মানুষ এই এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করতে পারবে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিপরীত পাশের কাওলা এলাকা দিয়ে যানবাহন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়দাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে কুতুবখালীতে গিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নামবে। পুরো এক্সপ্রেসওয়েতে ১১টি টোল প্লাজা থাকবে।


বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প

মেট্টোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের পাশাপাশি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। ২০২০ সালের মে মাসে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর বাসিন্দাদের পাশাপাশি গাজীপুরসহ আশপাশের বাসিন্দারাও সুফল ভোগ করবে। এই প্রকল্পের আওতায় উত্তরার হাউজবিল্ডিং থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বিশেষ বাস লাইন চালু হবে। ১৪০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার ১৮ মিটার দৈর্ঘ্যরে ‘আর্টিকুলেটেড’ বাস চলাচল করবে। ৯৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চীনের জিয়াংসু প্রভেনশিয়াল ট্রান্সপোটেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ৩০ মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।


সূত্র জানায়, এই প্রকল্পের কারণে টঙ্গি ব্রিজটি ১০ লেনে উন্নীত করা হবে। উত্তরার হাউজবিল্ডিং এলাকা থেকে টঙ্গির চেরাগ আলী পর্যন্ত সাড়ে ৪ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় এলিভেটেড স্টেশন নির্মাণ করা হবে। স্টেশনে স্বয়ংক্রিয় টিকেটিং কাউন্টার থাকবে। পাশাপাশি ই-টিকেটিংয়েরও ব্যবস্থা থাকবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে