মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফেরত পাঠাতে ‘সব ধরনের উদ্যোগ’ নেওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন ব্রুনেই সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়া। ব্রুনেইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগওয়ানে আজ সোমবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠকে সুলতান বলকিয়ার এই মত প্রকাশ করেন।
সুলতানের বাসভবন ইস্তানা নুরুল ইমানের চেরাদি লায়লা কেনচানায় শেখ হাসিনার সঙ্গে এই বৈঠক হয় বলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের জানান।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা ইস্যুতে (সুলতান) বেশ বড় একটা বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সবাই মিলে একটা সমাধানে আসা উচিৎ। আমাদের সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ, যাতে তারা ফিরে যেতে পারে।”
২০১৭ সালের অগাস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরুর পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তার আগে গত কয়েক দশকে এসেছে আরও চার লাখ রোহিঙ্গা।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো।
তবে মিয়ানমার সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
মিয়ানমার বলে আসছে, তাদের নাগরিকদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে আছে, যাচাই বাছাই করে তাদের ফিরিয়ে নিতে তারা তৈরি আছে। কিন্তু জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারে এখনও রোহিঙ্গাদের ফেরার মত অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
আর রোহিঙ্গারা বলছে, নিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা পেলেই কেবল তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাববে।
শহীদুল হক বলেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে আসিয়ানের বড় ইনভলভমেন্ট চেয়েছেন এবং এ ব্যাপারে ব্রুনেইয়ের সুলতানের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
“আর সুলতান রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে আসিয়ানের ইনভলভমেন্টের কথা বলেছেন আসিয়ান হিউম্যানেটেরিয়ান সেন্টারের কনটেক্সটে।”
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ‘শক্তিশালী’ করার ব্যাপারে ব্রুনেই সবসময় সহায়তা করে যাবে- এমন আশ্বাস সুলতানের তরফ থেকে এসেছে বলে জানান পরারাষ্ট্র সচিব।
সুলতানের আমন্ত্রণে তিন দিনের সরকারি সফরে রোববার বন্দর সেরি বেগওয়ানে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সোমবার সকালে তিনি সুলতানের বাসভবনে পৌঁছালে প্রটোকল ভেঙে এগিয়ে এসে সুলতান বলকিয়ার ও যুবরাজ হাজী আল মুহতাদি বিল্লাহ তাকে স্বাগত জানান।
রাজ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর সুলতানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। বৈঠক শেষে তাদের উপস্থিতিতে ছয়টি সমঝোতা স্মারকে সই ও একটি কূটনৈতিক নোট বিনিময় হয়।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “গত নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান সুলতান। তিনি বলেন, ”এটা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে জনগণের রায়। দুই দেশের সম্পর্কের সম্প্রসারণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর মাইলফলক হয়ে থাকবে বলেও মন্তব্য করেন সুলতান।”
পররাষ্ট্র সচিব আরো বলেন, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর যে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে, সে বিষয়টি বৈঠকে তুলে ধরেন সুলতান বলকিয়া। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাংলাদেশের চলমান আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৬ প্রস্তাব দিলেন প্রধানমন্ত্রী
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “সুলতানের সঙ্গে বৈঠকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ছয়টা প্রস্তাব দিয়েছেন।তিনি বলেছেন, দুদেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এজন্য দুদেশের মধ্যে একটা প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জেমেন্ট করার বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা যেতে পারে।
“প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুদেশের মধ্যে জয়েন্ট কমিশন করার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে আলোচনা করা দরকার। পাটজাত পণ্য, কৃষি পণ্য, সফটওয়্যার, জাহাজ, সিরামিক এসব পণ্যের কথাও তিনি তুলে ধরেছেন।”
সুলতান এসব ব্যাপারে ‘খুব ইতিবাচক’ উত্তর দিয়েছেন জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশে যে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে সেখানে ব্রুনেইয়ের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে পারে বলে সুলতানকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
“দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে দুই দেশের মধ্যে দ্বৈত কর পরিহারের ওপরও জোর দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের কথা উল্লেখ করে বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালসে ব্রুনেইয়ের সঙ্গে বড় ধরনের সহযোগিতা হতে পারে বলে তিনি মত দিয়েছেন।”
পররাষ্ট্র সচিব জানান, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান যোগাযোগ চালুর বিষয়টি দুই নেতার কথাতেই এসেছে। প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ করার প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
“নন-উইপেন রিলেটেড অঞ্চলে সামরিক সহযোগিতার বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। হিউম্যানিটি, অপারেশন্স, নলেজ শেয়ারিং… সুলতানও কিন্তু শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবদানের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।”
ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচ রাষ্ট্র বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও ইন্দোনেশিয়া মিলে একটি অর্থনৈতিক জোট গড়ার সম্ভাবনার কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে বলেন।
তিনি ব্রুনেইয়ের সুলতান ও তার স্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে সুলতান তা গ্রহণ করেন বলে পররাষ্ট্র সচিব জানান।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের সময় প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও স্পিচ রাইটার নজরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার বিকালে এম্পায়ার হোটেলে ব্রুনেই ও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনুষ্ঠেয় এক বৈঠকে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। পরে তিনি জামে আসর মসজিদ পরিদর্শন করবেন এবং সেখানে আসরের নামাজ আদায় করবেন। রাতে সুলতানের দেওয়া ভোজসভাতেও তিনি যোগ দেবেন।
মঙ্গলবার সকালে ব্রুনেইয়ের রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা জালান কেবাংসানে বাংলাদেশ হাই কমিশনের নতুন চ্যান্সেরি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন শেখ হাসিনা। পরে তিনি রয়েল রেজালিয়া জাদুঘর পরিদর্শন করবেন।
সেদিন স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় ঢাকার উদ্দেশে ব্রুনাই ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যায় ঢাকা পৌঁছানোর কথা রয়েছে তার।