বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের ট্যুরিজম বা পর্যটন শিল্প নিয়ে দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় লিখেছি। আরো অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু সে কথাগুলো এতকাল সংশ্লিষ্ট কারো গোচরে প্রবেশ করেছে বলে মনে হয় না। সবাই জানে যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ যেসব ক্ষেত্রে যোজন যোজন মাইল পিছিয়ে আছে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে পর্যটন খাত। সেই সঙ্গে এটাও হলফ করে বলা যায় যে আধুনিক বিশ্বে পর্যটন খাতকে অবহেলা করে অথবা পিছিয়ে থেকে কোনো স্বল্প আয়ের দেশ অর্থনৈতিক শক্তির প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে না। কারণ এটি একটি অপরিহার্য খাত, এ খাতে যারা পারফর্ম করতে পারবে না, তারা টিকে থাকবে না। হিসাবটা খুবই সহজ। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর কত মানুষ বাইরের দেশে যায় তার কোনো সুনির্দিষ্ট ডাটা পর্যটন করপোরেশন বা এর সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরে নেই (এই আরেক বিড়ম্বনা, আরেক লেখায় বলব)। বহু দপ্তরের ওয়েবসাইট এবং ইন্টারনেট ঘেটেও এ সংক্রান্ত কোনো ডাটা পাইনি। এটি অপরাগতার একটি নিদর্শন।
তবে অনুমান করি, দেশে থেকে বিভিন্ন দেশে সফরে যাওয়া লোকের সংখ্যা বছরে ২০ লাখের কম না। এরমধ্যে একটি বড় অংশ যায় চিকিৎসার জন্য, হজ পালন করতে এবং বেড়াতে। যে কারণেই যাক, তাদের সঙ্গে যায় দেশের মুদ্রা। ইদানীং ঈদ, পুজো, বড়দিন, থার্টি ফার্স্ট এবং নানা উপলক্ষে কয়েক লাখ মানুষ যান থাইল্যান্ড, ভারত, সিঙ্গাপুর, ভুটান এমন কি ভিয়েতনামেও। এই ২০ লাখ মানুষ মাথাপিছু মাত্র ১০ হাজার টাকা ব্যয় করলে দেশ থেকে কত অর্থ বের হয়ে যায় তা অনুমান করলে বিস্মিত হতে হয়। যারা যাতায়াত করেন তারা জানেন, ১০ হাজার টাকা ১ বা দুদিনের খরচ কারো কারো জন্য। ঠিক আছে, মানুষ তো যাবেই এবং অর্থ দেশ থেকে বের হবেই। কেবল দেশের অর্থ দেশে রাখার জন্য তো আর মানুষ বিনোদন, চিকিৎসা, বেড়াতে যাওয়া বন্ধ রাখতে পারে না। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রতিটি দেশের একই খাতে অর্থ-কড়ি ভেতরেও প্রবেশ করতে হয়, যাকে ইংরেজিতে বলে ইনফ্লুক্স। অর্থাৎ, পৃথিবীর প্রায় সব দেশই ট্যুরিজম থেকে কম-বেশি আয় করে থাকে, শুধু বাংলাদেশ ছাড়া। এরচেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বাংলাদেশের পর্যটকদের মাধ্যমে আয় বা পর্যটক আগমনের সংখ্যা যে কোনো ১৬ কোটি বা তদোর্ধ লোকসংখ্যার দেশের তুলনায় কম তো বটেই, কাছাকাছিও না (পাকিস্তান এবং যুদ্ধরত দেশ ছাড়া)। কেবল মালদ্বীপের উদাহরণ থেকে বোঝা যাবে পর্যটনে বাংলাদেশের দৈন্য। মালদ্বীপ আমাদের পার্শ্ববর্তী একটি দেশ। খুবই ছোট একটি দ্বীপ দেশ। মাত্র ৪ লাখ ৩৬ হাজার লোকের বাস। সেখানে গত বছর ১৭ লাখ ট্যুরিস্ট এসেছে! মালদ্বীপের প্রধান আয়ের উৎস এখন মাছ নয়, পর্যটন!
পর্যটক আগমনের প্রধান উৎস সমুদ্র সৈকত বা সী বিচ। মালদ্বীপের আছে চারদিকে সমুদ্র সৈকত। এর বাইরে নেই কোনো ঐতিহাসিক স্থান, নেই জীব বৈচিত্র, উদ্ভিদ বৈচিত্র, নেই কৃষির সৌন্দর্য অথবা স্রোতস্বীনি নদী বা পাহাড়। বাংলাদেশের এগুলো সবই আছে। সেই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন অনেক লোক। সরকারেরও যথেষ্ট মাথা ব্যথা আছে পর্যটন নিয়ে। তারপরেও বাংলাদেশে মালদ্বীপের কাছাকাছি পর্যটক আসে না কেন? (একটি কথা জানিয়ে রাখি। পর্যটন করপোরেশন পর্যটকের যে হিসাব দেয় তা নিরেট আইওয়াশ। বিদেশি ডেলিগেট আসেন বাংলাদেশে অসংখ্য। আসেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ি ও কোম্পানীর এক্সিকিউটিভরা। এই পেশাগত কারণে বাংলাদেশে আসা লোকদের পর্যটক হিসাবে গণনা করা কুমীরকে শেয়ালের বাচ্চা গুণে দেখানোর সামিল।)
আমাদের এই দেশ তো আফগানিস্তান নয়, পাকিস্তান নয়। তাহলে আমরা ট্যুরিস্ট পাই না কেন তা ভেবে দেখার দায়িত্ব কার? শুধু ঢালাও আয়োজন করলে হবে না, সেই সঙ্গে এ কথাটাও ভেবে দেখতে হবে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান তার এক সাক্ষাৎকারে খুবই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে। নানা আয়োজনের কথা বলেছেন। ভালো খাবারের ব্যবস্থা, হোটেল-মোটেল এসবের প্রতি তিনি জোর দিয়েছেন। এমন আশার কথা তিনি একা নন, বিগত দিনের পর্যটন কর্পোরেশনের কর্ণধাররাও শুনিয়েছেন, কিছুই হয়নি। কিন্তু আসল কথা কেউ মাথায় নেন না। শত হোটেল-মোটেল হলেও, মাগনা খাবারের ব্যবস্থা করলেও চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, পর্যটন কোনোক্রমেই ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না যদি আসল কথা না ভাবা হয়। কী উদ্যোগ নিতে হবে সে কথায় পরে আসছি। আগে অন্তরায়ের কথা বলি। পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আখতারুজ জামান খান কবির তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি যেসব উদ্যোগ নেবেন তা হবে সামাজিক নর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রেখে। আমি তার কাছে জানতে চাই, ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর অন্যতম বড় মুসলিম দেশ। তারা সমুদ্র সৈকত বালিতে কি ইন্দোনেশিয়ার সামাজিক নর্ম আর ধর্মীয় মূল্যবোধের থলি নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়? বালি একটি আন্তর্জাতিক ট্যুরিস্ট স্পট। সেখানে আন্তর্জাতিক মূল্যবোধই চলে, স্থানীয় মূল্যবোধ না। চেয়ারম্যান কি এভাবে চিন্তা করতে পারতেন না যে ধর্ম থাকবে যার যার, কিন্তু পর্যটন স্থানগুলোতে কোনো রকম কোনো নির্দিষ্ট মূল্যবোধ প্রয়োগ করা যাবে না। সেই জায়গা থাকবে ট্যুরিস্টদের জন্য মুক্ত এলাকা। সেখানে মূল্যবোধ নিয়ে যারা যাবেন, তাদেরকে ঢুকতে দেয়া হবে না।
চারটি বিশেষ ব্যবস্থা পর্যটনের জন্য জরুরি যার একটিও পর্যটন করপোরেশন বা বাংলাদেশ সরকার পূরণ করতে পারেনি : ১. আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিশ্চিত করা ২. যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে মসৃণ করে তোলা ৩. নির্দিষ্ট এলাকা টুরিস্টদের জন্য অবাধ করে দেয়া, যেখানে সাবলীলভাবে বিদেশি মেয়েরাও চলাচল করতে পারে এবং ৪. ব্যাপক প্রচারণা চালানো আন্তর্জাতিক বাজারে। এ কাজগুলো করতে পারলে প্রয়োজন হবে না বিমানের বা হোটেলগুলোর বিশেষ ছাড় দেয়ার। দেখবেন হুহু করে পর্যটক ঢুকছে। কাউকে ডেকে আনতে হবে না। কিন্তু পারবেন তা করতে? চেয়ারম্যান মহোদয় নিজেই প্রস্তুত না, তো অন্যরা পারবেন কী করে? তাকেই আগে বুঝতে হবে যে ট্যুরিজম একটি ব্যবসা, এর সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধের কোনো সম্পর্ক নাই। ইন্দোনেশিয়া কিন্তু বৃহৎ মুসলিম দেশ এবং মালদ্বীপ কিন্তু শতভাগ মুসলমানের দেশ! তারা মূল্যবোধকে টেনে পর্যটন এলাকায় নিয়ে যায়নি।
প্রথম দুটো শর্ত নিয়ে কোনো কথা নেই। সেটা সবাই জানে। পর্যটন ছাড়াও প্রথম দুটো শর্ত পূরণ করা নির্বাহী বিভাগের অবশ্য করণীয়। কিন্তু পর্যটন শিল্প জনপ্রিয় করতে প্রয়োজন আরো বাকী দুটো শর্ত পূরণ। বিদেশি পর্যটকদের জন্য আমাদের সমুদ্র সৈকতগুলোতে সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করে দিতে হবে। সেখানে যে-সে ঢুকতে পারবে না। মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে তা-ই করা হচ্ছে। সেই সংরক্ষিত এলাকায় থাকবে বার, নাইটক্লাব এবং নানা বিপণন সামগ্রি। ওই এলাকায় বিদেশিনীরা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরবে, অথবা পরবেই না। সমুদ্র সৈকতের এটাই বৈশিষ্ট্য। বিশ্বব্যাপী যারা সমুদ্র সৈকতে যান তাদের বড় একটি অংশ বিয়ার পান করতে করতে রোদ্রস্নান করেন। সে সুযোগ কক্সবাজার অথবা কুয়াকাটায় না থাকলে পর্যটক আসবে কেন কেউ বলতে পারেন?
এবার বলি চার নাম্বার শর্তের কথা। একবার আমি জার্মানির একটি চেইন শপে ঢুকে দেখতে পেলাম হাড়ি-পাতিল, জামা কাপড়, জুতা থেকে শুরু করে সবকিছু বিক্রি হচ্ছে। মার্কেটের ভেতর নানা কিছু দেখতে দেখতে গেলাম কিছু বই রাখা একটি জায়গায়। দেখলাম সেখানে খুব যত্নের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের উপর আকর্ষণীয় সব ভ্রমণ গাইড বিক্রি হচ্ছে। সেখানে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল থেকে শুরু করে আফ্রিকার ছোট ছোট দেশেরও ট্যুর গাইড আছে। রঙ্গীন আকর্ষণীয় ছবি সম্বলিত ওই সব ছোট ছোট (কোনো কোনোটা অবশ্য বিস্তারিত এবং আকারে ঢাউস) বুকলেটে এত সুন্দর পরিকল্পিতভাবে বিজ্ঞপ্তি করা যে হাতে নিলেই মনে হয় ‘আহা, বেড়াতে যেতে পারলে ভালো হতো’। যাহোক, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশের উপর কোনো বুকলেট আছে কিনা খুঁজলাম। হতাশ হয়ে দেখলাম–নাই। মনে হলো আমার চোখ কি এড়িয়ে গেল? গেলাম দোকানের কর্মচারির কাছে। তিনি কয়েক জায়গায় খোঁজখাবর নিয়ে জানালেন, বাংলাদেশের কোনো বুকলেট নাই। মনটা ভীষণ খারাপ হলো। ওগুলো তৈরিতে দূতাবাসগুলোর হাত থাকে। কিন্তু আমাদের দূতাবাসগুলোর সে সময় বা প্রয়োজন কই! আমাদের দূতাবাসগুলো কী করে সে গীত আর নাই বা গাইলাম।
সুতরাং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে পর্যটন মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে হবে প্রচার-প্রসারণার। বিশ্ববাসীকে জানাতে হবে যে আমাদের সমুদ্র সৈকত আন্তর্জাতিক মানের। তবে তার আগে সত্যিই আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে হবে। আর তা যদি না হয় তবে পর্যটন করপোরেশনকে প্রোমোট করার পেছনে সরকারের টাকা অপচয় করা ঠিক হবে না। ওই পয়সা অন্য সেক্টরে ব্যবহার করাই শ্রেয়। লোকাল যারা সমুদ্র সৈকতে যান তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করতে পারেন। সরকারের কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকলেও অভ্যন্তরীন পর্যটক কমবে না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে অনুরোধ রইল।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক