জাতীয় দলের ক্যাম্পে যোগদানের আগে দুই দিনের সফরে নিজের নির্বাচনী এলাকায় এসে ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন হাসপাতালকে। খেলোয়াড়ি জীবনেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া মাশরাফি গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টানা দুই ঘণ্টা ছিলেন নড়াইল আধুনিক সদর হাসপাতালে। দেখলেন হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনা, শুনলেন রোগীদের কথা। আর এলাকাবাসী দেখল, মাঠের মাশরাফির সেই রুদ্র মূর্তি।
দোতলায় হাসপাতালের নারী ও শিশু ওয়ার্ডে রোগীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছ থেকে নানা ধরনের সমস্যা শোনেন সংসদ সদস্য মাশরাফি।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তখন মাত্র একজন চিকিৎসক ছিলেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। পুরুষ ওয়ার্ডে মাত্র দুজন নার্স দেখে তাঁদের কাজের পালার ব্যাপারে খোঁজ নেন। জানতে পারেন হাসপাতালে পর্যাপ্ত নার্স থাকলেও দু-একজন নার্স দিয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ড পরিচালিত হচ্ছে। তখনই নিচে নেমে এসে নার্সিং সুপারভাইজরদের খোঁজ করেন। তাঁদের কক্ষে তালা দেখতে পেয়ে টেলিফোন করেন। একজন সুপারভাইজরের ফোন বন্ধ পান এবং অন্যজনের ফোন খোলা থাকলেও কথা বলেননি।
এরপর রোগীদের অনুরোধে হাসপাতালের বাথরুম ঘুরে দেখে মোবাইলে ছবি তুলে নেন। কয়েকটি বাথরুমের দরজা ভাঙা এবং দুর্গন্ধ তাঁকে অত্যন্ত বিব্রত করে। তিনি এ ব্যাপারে জানার জন্য আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে ফোন করতে বলেন। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর বিথী খাতুন এ সময় অফিসে উপস্থিত থেকে মাশরাফির নানা প্রশ্নের জবাব দিতে থাকেন। তিনি জানতে পারেন, হাসপাতালের চিকিৎসক সংকট থাকলেও নার্সের কোনো সংকট নেই। ৭৩ জন নার্স রয়েছে।
মাশরাফি আবার দোতলায় এসে চিকিৎসকদের অবস্থান জানতে চেয়ে হাজিরা খাতা দেখেন। অনেকের মধ্যে সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আকরাম হোসেন তিন দিন ধরে নেই দেখে ছুটির আবেদন দেখতে চান তিনি। পরে জানতে পারেন ছুটি ছাড়াই ওই চিকিৎসক তিন দিন ধরে অনুপস্থিত।
এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি প্রথমে রোগী হিসেবে ওই চিকিৎসককে ফোন করেন। চিকিৎসক অন্য প্রান্ত থেকে রোগীকে অর্থাৎ মাশরাফিকে রবিবার হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিতে বলেন। এ সময় নিজের পরিচয় দিয়ে মাশরাফি চিকিৎসককে বলেন, ‘এখন যদি হাসপাতালে কোনো রোগীর সার্জারি প্রয়োজন হয় তাহলে সেই রোগী কী করবে?’ চিকিৎসককে তাঁর কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ফিরে আসতে বলেন সংসদ সদস্য।
মাশরাফির হাসপাতালে আসার খবর পেয়ে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মশিউর রহমান বাবু ছুটে আসেন। আরেক চিকিৎসক ডা. আলিমুজ্জামান সেতুও চলে আসেন। এ সময় চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি বিষয়ে কথা বলে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারকে দিয়ে ডা. আকরাম হোসেনকে তিন দিনের অনুপস্থিত করিয়ে নেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কক্ষে বসে তিনি তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুরকে ফোন করেন। সে সময় তিনি খুলনায় একটি সভায় অংশগ্রহণ করে মাগুরায় বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। কর্মস্থলে অবস্থান করার কথা জানিয়ে রাতের মধ্যেই তাঁকে হাসপাতালে চলে আসতে বলেন মাশরাফি। তবে এক ঘণ্টার মধ্যেই হাসপাতালে চলে আসেন তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুর।
এরপর হাসপাতালের নানা স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন এমপি মাশরাফি, তখন এক অন্য মূর্তি তাঁর, যেন জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন। হাসপাতালের আবর্জনাপূর্ণ নালা এবং নানা নোংরা পরিবেশ দেখে আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের কাছে জানতে চান তিনি। তখন ডা. মশিউর রহমান নড়াইল পৌরসভার ওপর দায় চাপিয়ে কোনো রকমে রেহাই পান।
এ সময় উপস্থিত দুই চিকিৎসক এবং কর্মকর্তারা মাশরাফির কাছে এসব ঘটনার খবর পত্রিকায় যেন ছাপা না হয় সে জন্য অনুরোধ করেন।
হাসপাতালের সংক্রামক ওয়ার্ডে গেলে রোগীরা নানা অভিযোগ করে সংসদ সদস্যের কাছে। তারা বলেন, বাইরে থেকে স্যালাইন কিনে আনতে হয়। এই অভিযোগ শুনে তিনি হাসপাতালের বাইরের দোকানগুলোতে সরকারি স্যালাইন পাওয়া যায় কি না তা দেখার জন্য নির্দেশ দেন। পরে হাসপাতালে ওষুধ সংকট শুনে স্টোরকিপারকে ডাকেন। তাঁকে না পেয়ে রাতে আবার সভা করবেন বলে তখনকার মতো বেরিয়ে আসেন।
তারপর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টায় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, সিভিল সার্জন, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের সঙ্গে সভা করেন সংসদ সদস্য মাশরাফি। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, হাসপাতালের অবকাঠোমো দেখভাল করা প্রতিষ্ঠান গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী। সভাটি হয় রুদ্ধদ্বার।
পরে জানা যায়, সভায় হাসপাতালের নানা অনিয়মের মধ্যে বাইরের অ্যাম্বুল্যান্স, দালাল ও ওষুধ কম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের কঠোরভাবে দমনের কথা বলেন মাশরাফি। তিনি আগামীতে এসব ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি হাসপাতালকে মানুষের সেবার জন্য উন্মুক্ত করতে বলেন।
আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. মশিউর রহমান বাবু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হাসপাতালের প্রধান সমস্যা হলো চিকিৎসক সংকট। আমরা যে কয়জন আছি তারা প্রত্যেকে যদি এক শ ভাগ সেবা দিই তাহলে অবস্থার উন্নতি হবে।’ পরিচ্ছন্নতাকর্মী সংকট এবং পৌরসভার সহযোগিতা না করার কারণে ময়লা-আবর্জনা সরানো সম্ভব হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন।
সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুস শাকুর। তিনি গত বুধবারই হাসপাতালে যোগদান করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে এসেই কয়েকজন চিকিৎসকের গাফিলতি লক্ষ্য করেছি। এমপি সাহেব যেভাবে আজ দেখলেন, আর যা বললেন তাতে আমার কাজটি অনেক সহজ হয়ে গেল। এখন আর কেউ আমার বিরুদ্ধে দল পাকাতে পারবে না।’
হাসপাতাল পরিদর্শনের ব্যাপারে সংসদ সদস্য মাশরাফি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো চিকিৎসা। এই সেবার মান নিশ্চিত করতে আমার যা কিছু করার সবই করব। কিছু মানুষের জন্য নিরীহ জনগণ কষ্ট পাবে, এটা কেউই সহ্য করবে না।’