রাজধানীতে ২৫০০ কোটি টাকা খরচেও জলাবদ্ধতা কমছে না

ডেস্ক রিপোর্ট

রাজধানীর জলাবদ্ধতা
রাজধানীর জলাবদ্ধতা। ফাইল ছবি


রাজধানীর খাল ও ড্রেন পরিষ্কারের নামে সংস্থাগুলো শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও খাল ও পানি নিষ্কাশন নালাগুলো আবর্জনায় পূর্ণ রয়েছে।

গত ১০ বছরে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হলেও জলাবদ্ধতা কমছে না। বরং উল্টো অনেকাংশে বেড়েছে। এখন মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত তলিয়ে যাচ্ছে।

ঘণ্টায় ৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সক্ষমতা আছে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো এমন দাবি করলেও ২৫-৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা জলাবদ্ধতা কম হওয়ার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো প্রায় দুই হাজার ৫৬১ কোটি টাকা খরচ করেছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে ঢাকা ওয়াসা নগরীর খাল, ড্রেন পরিষ্কার ও সংস্কার কাজে প্রায় ৬৮৩ কোটি টাকা খরচ করেছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) যৌথভাবে এক হাজার ৭৭০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রায় ১০৮ কোটি টাকা খরচ করেছে।

এবার বর্ষার ঘনঘটা শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৃষ্টিও হয়েছে। মাঝারি বৃষ্টিতেও রাজধানীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

এ নিয়ে সংস্থাগুলো ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছে। কোনো সংস্থা বলছে, অন্যবারের তুলনায় জলাবদ্ধতা কম হবে।

আবার কোনো সংস্থা বলছে, ঢাকার বিদ্যমান বাস্তবতায় রাজধানীতে জলাবদ্ধতা হবে, এটা নগরবাসীকে মেনে নিতে হবে। প্রতি বছরের মতো এবারও পানি নিষ্কাশন খাল ও ড্রেন পরিষ্কারে ডিএনসিসি, ডিএসসিসি ও ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ঢাকা ওয়াসা) প্রায় ৫০০ কোটি টাকা খরচে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

ঢাকা ওয়াসা অন্যবারের মতো এবারও ৬৫ কোটি টাকা খরচ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এরপরও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো নগরবাসীকে বাস্তবসম্মত আশার কথা শোনাতে পারছে না- ভারি বৃষ্টি হলে নগরীর অবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, তার কোনো কূলকিনারা করতে পারছেন না তারা।

সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর খাল ও ড্রেন পরিষ্কারের নামে সংস্থাগুলো শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও খাল ও পানি নিষ্কাশন নালাগুলো আবর্জনায় পূর্ণ রয়েছে। মহানগরীর রামচন্দ্রপুর খাল, হাজারীবাগ খাল, বছিলা খাল, বুড়িগঙ্গা শাখা খাল, মিরপুর সাংবাদিক কলোনি খাল, বাড্ডা খাল ও জিরানী খাল আবর্জনায় পূর্ণ।

মিরপুর সাংবাদিক কলোনি খালের বিষয়ে ডিএনসিসির জনসংযোগ বিভাগ থেকে সম্প্রতি নিজস্ব ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলেছে, কিছুদিন আগে ডিএনসিসি মিরপুর সাংবাদিক কলোনি খাল পরিষ্কার করলেও আবারও তা আবর্জনায় ভরে গেছে।

ওই ভিডিও প্রকাশ করে বোঝানো হয়েছে, নগরবাসী সচেতন না হলে রাজধানীর বিদ্যমান এ সমস্যার সমাধান হবে না। বাড্ডা খাল প্রতি বছরের মতো গত বছরও পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি সরেজমিন দেখা গেছে, আবর্জনায় খালটি ভরাট হয়ে গেছে।

গত বছর পরিষ্কার ও খনন করার পরও মহানগরীর রামচন্দ্রপুর, বছিলা, হাজারীবাগ, জিরানী ও সেগুনবাগিচা খাল আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। সম্প্রতি এ খালগুলোর করুণ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে।

এ অবস্থায় ভারি বৃষ্টি হলে এসব খাল পানি নিষ্কাশনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।


দুই সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার সমন্বয়ের অভাবে জলাবদ্ধতা

জানা গেছে, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন আইন-১৯৯৬ অনুযায়ী বৃষ্টির পানি অপসারণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ১৯৮৯ সাল থেকে ড্রেনেজ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে রীতিমতো ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এটা মূলত ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার সমন্বয়ের অভাবের কারণেই হচ্ছে।

ঢাকা ওয়াসার মূল দায়িত্ব থাকলেও এ সংস্থার নর্দমার পরিমাণ ৩৭০ কিলোমিটার। এর বাইরে ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট, ৮০ কিলোমিটার খাল এবং চারটি স্থায়ী পাম্প স্টেশন (কল্যাণপুর, ধোলাইখাল, রামপুরা, কমলাপুর) রয়েছে।

এর বাইরে বর্ষার মৌসুমে অস্থায়ী ভিত্তিতে ১৫টি পাম্প স্টেশন বসানো হয়। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের গোড়ান চটবাড়ীতে একটি স্থায়ী পাম্প স্টেশন রয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নর্দমা বা ড্রেনের পরিমাণ আড়াই হাজার কিলোমিটার। এখনও প্রতি বছর জলাবদ্ধতা নিরসনে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করছে দুই সিটি কর্পোরেশন। আর ঢাকা ওয়াসার উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম তুলনামূলক কম। গত অর্থবছরে পাঁচটি খাল পুনর্খনন প্রকল্প অনুমোদন হওয়ায় সেটা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

জানা যায়, ২০১৩ ও ২০১৪ সালে জলাবদ্ধতা নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে ড্রেনেজের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চায় ঢাকা ওয়াসা। ২০১৪ সালের ৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবকে এ ব্যাপারে চিঠি দিয়ে অবহিত করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান।

ওই চিঠিতে বলা হয়, ১৯৮৯ সালে পানি নিষ্কাশনের কাজ ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পাইপলাইন কয়েকগুণ বেশি।


বার্ষিক পরিচ্ছন্নতা কাজে সমন্বয় নেই

বার্ষিক পরিচ্ছন্নতা কাজের ব্যাপারে দুই সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ কারণে সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয় এবং এজন্য ঢাকা ওয়াসাকে দোষারোপ করা হয়।

ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা একটি সংস্থার কাছে থাকা বাঞ্ঝনীয় বলে বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে। এ কারণে ঢাকা ওয়াসার স্ট্রম ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা যায়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, ওয়াসার খাল সংস্কারে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এজন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ৪০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে ইতিমধ্যে কিছু টাকা পাওয়া গেছে। সেগুলোর কার্যাদেশও দেয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসন্ন বর্ষায় যাতে জলাবদ্ধতা না হয়, সেজন্য বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ৫০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা হবে না। এর বেশি হলে জলাবদ্ধতা হবে। তবে তিন ঘণ্টার মধ্যে তা নিষ্কাশনের চেষ্টা করা হবে। এর চেয়েও ভারি বর্ষণ হলে সেটার দুর্ভোগ নিরসন খুব কঠিন হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, আমরা জলাবদ্ধতার স্থায়িত্ব কমিয়ে আনতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিদ্যমান বাস্তবতা নগরবাসীকে মেনে নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কিছু খাল পরিদর্শন করেছি। এগুলোর বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নিতে বলেছি।

তিনি বলেন, রাজধানীর খাল বা পানি নিষ্কাশন খালগুলো অকেজো বা দখল হয়ে যাওয়ার পেছনে নগরবাসীরও দায় রয়েছে। বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করতে এখন নগরবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে