শীতল সরকার এলাকায় সুপরিচিত একটি নাম। নামের সঙ্গে বেশ মিলও রয়েছে তার আচার-ব্যবহারে। মহল্লার ৮০ বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে যুবক, শিশু-কিশোর সবাই তার বন্ধু। দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে সংগ্রাম করছেন একটি সাফল্যের জন্য। অবশেষে গত ৫ মে সাফল্যের দেখা মিলে ৬৪ বছর বয়সী শীতল সরকারের জীবনে।
দেশের প্রচীনতম পৌরসভার একটি ময়মনসিংহ পৌরসভা। সেই পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কমিশনার প্রার্থী হিসেবে শীতল সরকার প্রথম নির্বাচনে অংশ নেন ১৯৮১ সালে। প্রথম নির্বাচনে পাস করতে না পারলেও ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পান তিনি। সেই সাহস নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনেও অংশ নেন তিনি। কিন্তু অল্পের জন্য জয়ের দেখা পাননি।
এভাবে চলে তার প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ। কোনো সময় এলাকাবাসী তার পাশে দাঁড়িয়েছে, কোনো সময় দাঁড়ায়নি। তবু থেমে থাকেনি শীতল সরকার। নির্বাচনে পরাজয়ের পরদিনই মান-অভিমান ভুলে আবারও ছুটেছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। বিষয়টি হয়তো কেউ ভালো চোখে দেখেছে কেউ দেখেনি।
এভাবে চলে তার একে একে ৬ বার কমিশনার ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে অংশ নেয়া। সর্বশেষ ২০১১ সালে ময়মনসিংহ পৌরসভার সর্বশেষ নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি। শীতল সরকারের অভিযোগ- ২০১১ সালের নির্বাচনে পাস করলেও তাকে অন্যায়ভাবে হারানো হয়েছিল।
২০১১ থেকে ২০১৯ দীর্ঘ আট বছর। এর মাঝে ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। হয়েছে নতুন বিভাগ। ২০১৮ সালে প্রাচীনতম এই পৌরসভাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে গঠন করা হয় দেশের ১২তম সিটি কর্পোরেশন। ২০১১ সালে পরাজয়ের পর থেকে নতুন করে পথ চলা শুরু করে শীতল সরকারও।
অবশেষে তফসিল, মনোনয়ন জমা, প্রতীক বরাদ্দ। প্রতীক বরাদ্দের দিন মিষ্টি কুমড়া প্রতীক নিয়ে ওয়ার্ডবাসীর কাছে হাজির শীতল বাবু। ৫ মের নির্বাচনে শীতল সরকার ২২৬১ ভোটে মিষ্টি কুমড়া প্রতীক নিয়ে কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আল-মাসুদ পান ১৬৫৯ ভোট।
শীতল সরকার বলেন, ঝিনুক লুকিয়ে থাকে মুক্তার ভেতর। ৩৮ বছর পর এই ওয়ার্ডের মানুষ মুক্তার দেখা পেয়েছে। এই এলাকার জনগণের কাছে আমি ঋণী। তাদের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণায় আজ আমি জনপ্রতিনিধি। আমি আমার কর্ম দিয়ে আমার ওয়ার্ডবাসীর ঋণ শোধ করব। এই ওয়ার্ডে মুসলমান ছাড়াও অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। আমার সব চেয়ে বড় কাজ হলো এই এলাকায় ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা। পরে রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ময়লা আবর্জনা নিয়ে কাজ করা।
টাকাওয়ালা প্রার্থীদের ভিড়ে কীভাবে নির্বাচন করার সাহস পেলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সাহস পেয়েছি জনগণের চোখের পানি আর ভোটারের ভোটের আশ্বাসে। আমার ভোটে কোনো টাকা বা চা সিগারেটের ছোঁয়া নাই। আমি প্রমাণ করেছি টাকা দিয়ে গরু-ছাগল কেনা যায়, ভোট কেনা যায় না। ভোট পেতে হলে ভালোবাসা আর আন্তরিকতা লাগে।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে (ইভিএম) ধন্যবাদ জানিয়ে শীতল সরকার বলেন, ইভিএম না থাকলে বিগত নির্বাচনের মতো এবারেও আমাকে কারচুপির মাধ্যমে হারানো হতো।
- আরও পড়ুন >> রাজধানীতে ২৫০০ কোটি টাকা খরচেও জলাবদ্ধতা কমছে না
টাকা-পয়সা ছাড়া কীভাবে এতো বড় একটা নির্বাচন করলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এলাকার জনগণ আমার পোস্টার-লিফলেট-মাইকিং থেকে শুরু করে সব কাজ করে দিয়েছে। আমি ভোটারদের এক কাপ চা খাওয়ানোতো দূরের কথা আমার একটি কর্মীকেও এক কাপ চা খাওয়াইতে পারি নাই। তাদের এই ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না।
ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে চলছিল শীতল সরকারের সংসার। অভাব অনটনের সংসারে বার বার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজয়ের কারণে আজ থেকে ১৫ বছর আগে অভিমানে স্ত্রী তার দুই সন্তানকে নিয়ে চলে যান বাবার বাড়িতে। সেই থেকে শেষ সম্বল নিজ ভিটেতেই একাকী জীবন কাটান শীতল সরকার।
শীতল সরকারের বাল্যবন্ধু নজরুল ইসলাম বলেন, খুবই সহজ সরল ও সৎ জীবন-যাপন করেন শীতল সরকার। ২০১১ সালে আমরা দুইজনই এই ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করে পরাজিত হই। আমি আর নির্বাচনে অংশ না নিলেও শীতল এবার অংশ নেয়। ৩৮ বছর ধরে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করে চলছে সে। এবার মানুষের সহানুভূতিতে সে পাস করেছে।
৯নং ওয়ার্ডের জ্ঞানীর মোড় টেইলার্সের মালিক চন্দন দে বলেন, এলাকার মানুষ দায়বদ্ধ হয়ে শীতল সরকারকে ভোট দিয়েছে। ওয়ার্ডের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ চাঁদা দিয়ে শ্রম দিয়ে তাকে সাহায্য করেছে। এই এলাকার মানুষ প্রমাণ করেছে টাকা-পয়সার চেয়ে মানুষের সহানুভূতি অনেক বড়।