বাড়ছে না করমুক্ত আয়সীমা

অর্থনীতি ডেস্ক

বাড়ছে না করমুক্ত আয়সীমা
ফাইল ছবি

প্রতি বছরই ঘরভাড়া, চিকিৎসা, খাবার, যাতায়াত, সন্তানের পড়ালেখার খরচ বেড়েই চলেছে। অথচ এসব খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করমুক্ত আয়সীমা এক টাকাও বাড়ানো হচ্ছে না। করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা নির্ধারিত হয়েছিল ২০১৫-১৬ অর্থবছরে। এরপর প্রতি বছরই পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়েছে। তবু এই সীমা চলতিবার পর্যন্ত একই আছে।

আয়কর আইন অনুযায়ী আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব মিলিয়ে বছরে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি প্রকৃত আয় থাকলে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই আয়কর পরিশোধ করতে হবে। আয়কর পরিশোধ বা রিটার্ন জমা না দিলে শাস্তি হিসেবে জেল-জরিমানার বিধান আছে।


গত বছর জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে ৬%

২০১৬ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬.৪৭%, পরের বছর এর বৃদ্ধি হার ছিল ৮.৪৪%। গত বছর জীবনযাপনের খরচ বেড়েছে ৬%। একইসঙ্গে পণ্য ও সেবা মূল্য বেড়েছে ৫.১৯%। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এই হিসাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যাতায়াতের খরচ ধরা হয়নি। অথচ পারিবারিক ব্যয়ের একটা বড় অংশ যায় এ তিনটি খাতে।

ক্যাবের মতে, ব্যয় বৃদ্ধির অভিঘাত সীমিত আয়ের শহুরে মানুষের ওপর বেশি। ন্যূনতম চাহিদা মিটিয়ে সংসার খরচ বছরে আড়াই লাখ টাকায় (মাসে ২০ হাজার ৮৩৩ টাকা) ধরে রাখা নিম্ন ও নিম্ন মধ্যম পরিবারের পক্ষেও প্রায় অসম্ভব। তাই করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর জোরালো দাবি রয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। তবে করদাতা হারানোর ভয়ে এ দাবি মানতে রাজি নয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

তবে অর্থনীতি বিশ্লেষকরা ভিন্নমত জানিয়ে বলেন, করের বোঝা কমানো হলে করদাতার সংখ্যা কমবে না বরং বাড়বে। করমুক্ত সীমা বাড়ানো এবং এ ক্ষেত্রে করহার পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে।

জাতীয় বাজেটের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা করা হয়। এর বেশি আয় করলে একজন ব্যক্তিকে এক করবর্ষে তার আয়, ব্যয়, সম্পদের পরিমাণ এবং রেয়াত সব কিছু হিসাব করে এনবিআর নির্ধারিত হারে আয়কর হিসাবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।

বর্তমানে প্রথম দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শূন্য, পরবর্তী চার লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ, পরবর্তী ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫ শতাংশ, অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর পরিশোধের বিধান আছে।

এ ছাড়া মহিলা করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের করদাতার করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতার চার লাখ টাকা এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চার লাখ ২৫ হাজার টাকা করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারিত আছে।

মূল্যস্ফীতির হার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬.৪১, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫.৯২, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫.৪৪, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫.৭৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত এ হার ৫.৫৫ শতাংশ।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের প্রত্যেককে প্রতি মুহূর্তে পরোক্ষ কর হিসেবে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে ও সেবা কিনতে মোটা অঙ্কের অর্থ সরকারকে দিতে হচ্ছে। এসব ব্যয় বেড়েই চলেছে। সাধারণ আয়ের মানুষ এসব খরচে হিমশিম খাচ্ছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর হিসেবে বড় অঙ্কের অর্থ চাপিয়ে দিলে অল্প আয়ের মানুষের জন্য বোঝা হয়ে যায়।

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়ালে এবং প্রথম স্ল্যাবের ১০ শতাংশ কমিয়ে ৫ বা ৪ শতাংশ করা হলে তাদের ওপর চাপ কমবে। বেঁচে যাওয়া অর্থ নিজের, পরিবারের এবং সন্তানের জন্য ব্যয় করতে পারবে। তাদের সক্ষমতা বাড়লে তারা অল্প সময়ে করসীমায় চলে আসবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গণমাধ্যমকে বলেন, এনবিআরের ওপর রাজস্ব আদায় এবং করদাতা বাড়ানোর চাপ থাকে। তাই করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে অল্প কিছু মানুষকেও করসীমার বাইরে নিতে চায় না। কিন্তু করমুক্ত আয়সীমা  ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হলেও এনবিআরের মোট আদায়ে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ এনবিআরের মোট আদায়ের অতি সামান্য এসব মানুষের কাছ থেকে পাওয়া যায়।


করদাতাকে কমহারে সরাসরি কর দিতে হবে

তিনি বলেন, এ ছাড়া অল্প আয়ের মানুষের ওপর চাপ কমাতে আয়কর আদায়ের প্রথম হার ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৩ বা ৪ শতাংশ করা যেতে পারে। এতে করদাতার সংখ্যা কমবে না। কিন্তু করদাতাকে কমহারে সরাসরি কর দিতে হবে। ফলে করদাতা স্বস্তি পাবে। তারা করসীমায় টিকে থাকবে।

আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্তিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে এনবিআর প্রস্তাব সংগ্রহ করেছে। এসব নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রায় মাসব্যাপী দফায় দফায় বৈঠক করেছে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে হার পুনর্বিন্যাসের দাবিটি প্রস্তাবে ও আলোচনাকালে সবচেয়ে বেশিবার এসেছে।


সাধারণ আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে আগামী অর্থবছরে সাধারণ করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবি জানিয়ে বলা হয়েছে, চলতি এবং গত তিন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৫ শতাংশের ওপরে থাকলেও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। এতে সাধারণ আয়ের মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।

করমুক্ত সীমা বাড়ানোর বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, এখন ইটিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। কিন্তু রিটার্ন দিচ্ছে এর চেয়ে কম। করদাতার সংখ্যা ৮০ লাখ বা এক কোটি করা সম্ভব হলে করমুক্ত সীমা ২০ হাজার বা ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হলেও রাজস্ব আদায়ে তেমন প্রভাব পড়বে না।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে