দূরত্ব ২০০ মিটার, ভ্যান ভাড়া ৪০০ টাকা!

মহানগর ডেস্ক

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ। ছবি-সংগৃহিত

নগরীর লক্ষ্মীপুর মোড়থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের দূরত্ব সাকুল্যে ২০০ মিটারের মত। পায়ে হেঁটে যেত সময় লাগবে মিনিট দুয়েক। কিন্তু স্বল্প দূরত্বের এই পথ রোগীদের পাড়ি দিতেই অন্তত ৪০০ টাকা ভ্যান ভাড়া গুনতে হয়। অবিশ্বাস্য এই কাণ্ড প্রকাশ্যেই ঘটছে রামেক হাসপাতালে।

সরজমিনে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ এই ভ্যানচালকরা জিম্মি করছেন রোগী ও তাদের স্বজনদের। তাতে যোগসাজস রয়েছে হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের। হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের উদাসীনতায় দিন দিন বাড়ছে এদের দৌরাত্ম।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ জন রোগী চিকিৎসার জন্য আসেন রামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। এদের মধ্যে অন্তত দেড়শ রোগী থাকেন মুমূর্ষু অবস্থায়। যাদের জরুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। সার্বক্ষণিক রোগী ভর্তি হলেও দুপুর ১২টা পর্যন্ত রোগ নির্ণয় হয় হাসপাতালে।

চলতি বছরের গত ২৩ জানুয়ারি থেকে বিকল হাসপাতালের সিটি স্ক্যান মেশিন। সচল অবস্থায় সিটি স্ক্যান সেবা পেয়েছেন অন্তত ২০ জন রোগী। এমআরআই মেশিন সচল থাকলেও সেবা পাচ্ছেন দিনে পাঁচ থেকে সাতজন। এ ক্ষেত্রে ভরসা বাইরের রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলো। তাছাড়া দুপুরের পর ভর্তি রোগীদের রোগ নির্ণয়ে যেতে হচ্ছে বাইরেই।

ব্রেন স্ট্রোক করে বুধবার দুপুর ২টার দিকে হাসপাতালে আসেন খাইরুল ইসলাম (৬৫)। জরুরি বিভাগ থেকে তাকে পাঠানো হয়েছে নিউরো মেডিসিন বিভাগে। ওয়ার্ডের দায়িত্বরত ইন্টার্ন চিকিৎসক সিটি স্ক্যান-এমআরআই করাতে বলেন নগরীর বেসরকারি রোগ নির্ণয় কেন্দ্র পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে।

রোগীর স্বজনরা বলেন, পপুলারে নেয়ার জন্য জরুরি বিভাগের সামনে আসতেই রোগীর ট্রলি ঘিরে ধরেন কয়েকজন ভ্যান, অটোরিকশা ও মাইক্রোবাস চালক। আগে থেকেই জরুরি বিভাগের সামনের গাছ তলায় বসে ছিলেন তারা। রোগীর অবস্থা বিবেচনায় ভ্যানে নেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। আর এ জন্য গুনতে হলো ৪০০ টাকা ভাড়া।

সিটি স্ক্যান শেষে ওই ভ্যান রোগী পৌঁছে দিয়ে গেলো হাসপাতালে। রোগ নির্ণয়ে বাড়তি খরচের সঙ্গে বাড়তি ভ্যান ভাড়ায় চরম বিপাকে তারা। এনিয়ে ক্ষোভ জানানোর জায়গাও নেই।

সরেজমিনে গিয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অন্তত সাতটি ভ্যান নিয়ে চালকদের অপক্ষেমান পাওয়া গেলো। এরা হাসপাতাল সংলগ্ন আশেপাশের এলাকার বাসিন্দা। রোগী বহনের জন্য বিশেষ কায়দায় ভ্যান প্রস্তুত করেছেন তারা। এখানে অন্তত ১০জন ভ্যানচালক প্রতি দিন বসে থাকেন।

স্বল্প দূরত্বের ভাড়া এতো বেশি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করে একজন ভ্যানচালক বলেন, দিনে দুই থেকে তিনটি ভাড়া তারা পান। ক্লিনিকে আনা নেয়া ছাড়াও তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষাতেও সহায়তা করেন। হাসপাতালে থাকতে ম্যানেজ করতে হয় পুলিশ-আনসারদের। বাড়তি ভাড়া না আদায় করলে টেকা মুশকিল। তবে রোগীদের তারা জোর করেন না বলে দাবি করেন এই ভ্যানচালক।

এদিকে রামেক হাসপাতালের বেশির ভাগ ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, কোনো না কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রোগীদের যেতে হচ্ছে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গ্রীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিপ্যাথ, ল্যাব কেয়ার, নর্থ বেঙ্গল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালসহ লক্ষ্মীপুর মোড় ঘিরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে।

এসব বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করে রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জামিলুর রহমানকে পাওয়া যায়নি।

তবে রোগীদের কাছ থেকে বাড়তি ভ্যান ভাড়া নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. এনামুল হক। তার ভাষ্য, এনিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তেমন কিছুই করার নেই।

তিনি বলেন, হাসপাতালে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়, সেসব হাসপাতালেই করার কথা। কিন্তু বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কেন পাঠানো হচ্ছে বলতে পারবো না। এটা চিকিৎসকরাই ভালো বলতে পারবেন।

রামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের এই জিম্মি করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজশাহীর সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান।

তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই নানান অব্যবস্থাপনা চলে আসছে হাসপাতালে। এতে হাসপাতালের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এনিয়ে বিভিন্ন সময় আন্দোলনও করেছে রাজশাহীবাসী। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। সেবার মানোন্নয়নে অবিলম্বে এসব অব্যবস্থাপনা দূর করার দাবি জানান জামাত খান।

উল্লেখ্য, ১২শ শয্যার রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ওয়ার্ড রয়েছে ৫৭টি। প্রতিদিন হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নেন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী। সবচেয়ে বড় চিকিৎসা কেন্দ্র হওয়ায় পুরো অঞ্চলের রোগীরা ভিড় জমান রামেক হাসপাতালে। রোগীদের জিম্মি করে দীর্ঘদিন ধরেই হাসপাতাল কেন্দ্রিক নানান বাণিজ্য রমরমা।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে