অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দেওয়া জুনিয়র বৃত্তির ফল প্রকাশ আটকে আছে দু’মাস ধরে। সারাদেশের লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক এ বৃত্তির ফলের প্রতীক্ষায় দিন পার করছেন। এই ফল আটকে যাওয়ার কারণে তারা বৃত্তির টাকাও পাচ্ছে না। অষ্টম শ্রেণির ‘জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট’ (জেএসসি) ও মাদ্রাসার ‘জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট’ (জেডিসি) পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে যে শিক্ষার্থীরা জিপিএ ৫ পেয়ে নবম শ্রেণিতে ওঠে, তারা বৃত্তি পেয়ে থাকে। জেএসসির ফল প্রকাশ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। সাধারণত ফল প্রকাশের দু’মাসের মধ্যে বৃত্তির ফল প্রকাশ করা হয়। এ বছর ফল প্রকাশের চার মাস পার হতে চললেও এখনও বৃত্তির ফল প্রকাশ করা হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে নির্বিকার।
জুনিয়র বৃত্তির ফল কেন দেওয়া হচ্ছে না? জানতে চাইলে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, কিছু জটিলতার কারণে বৃত্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, মেধার ভিত্তিতে বৃত্তি দেওয়া হয়। এতে সাধারণত সর্বোচ্চ ফল জিপিএ ৫ প্রাপ্তরাই বৃত্তি পেয়ে থাকে। এবার বৃত্তি বণ্টন করতে গিয়ে দেখা গেছে, বহু উপজেলায় কেউই জিপিএ ৫ পায়নি। এতে সেই উপজেলায় বৃত্তি দিতে গেলে জিপিএ ৫-এর নিচে পাওয়াদের বৃত্তি দিতে হবে।
অন্যদিকে, দেশের অন্যান্য উপজেলায় আবার জিপিএ ৫ প্রাপ্তরাই বৃত্তি পাবে। কোথাও জিপিএ ৫ পেয়ে বৃত্তি, আবার কোথাও তা না পেয়েও বৃত্তি পেলে তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠতে পারে।
শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, বৃত্তি দেওয়ার একটি নীতিমালা আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতি উপজেলায়/থানায় মেধাবীদের বাছাই করে অর্ধেক ছাত্র ও অর্ধেক ছাত্রীর মধ্যে তা সমভাবে বণ্টন করতে হবে। অথচ এবারের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় সব উপজেলায় যেমন জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী নেই, আবার ছাত্র আর ছাত্রীদের মধ্যেও সমহারে জিপিএ ৫ পায়নি। তাই বিষয়টি জটিল হয়ে গেছে।
অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর এ বৃত্তির অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। তাই তাদের বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।
শিক্ষা বোর্ডের চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, বোর্ডের চিঠি তারা পেয়েছেন। বিষয়টি জটিল অথচ জনগুরুত্বসম্পন্ন। মন্ত্রণালয়ের জারি করা নীতিমালা শিথিল করা না হলে বৃত্তি বণ্টন করা সম্ভব নয়। তাই পুরো বিষয়টি জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
মাউশির সংশ্নিষ্ট শাখার উপপরিচালক মো. নুরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি সভা হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা হয়নি। ওই সভায় পেশ করার জন্য তারা মাউশির তরফ থেকে একাধিক বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতি উপজেলায়/থানায় মেধাবীদের বাছাই করে অর্ধেক ছাত্র ও অর্ধেক ছাত্রীর মধ্যে তা সমভাবে বণ্টন করতে বলা হলেও এ বছরের জন্য তা শিথিল করা হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদি কোনো উপজেলায় জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্রীর সংখ্যা কম হয়, তাহলে সেই বৃত্তিগুলো ওই উপজেলায় জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্রদের মধ্যেই বণ্টন করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হবে।
এদিকে, বৃত্তি দিতে বিলম্ব হওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের নবম শ্রেণির এক ছাত্রের বাবা বলেন, সারাদেশে ২০-২২ লাখ ছাত্রছাত্রীর অভিভাবক বৃত্তির ফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। কোনো বছর এত বেশি বিলম্ব হয়নি। বিলম্বের কারণও জানা যাচ্ছে না বলে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর সূত্র জানায়, মূলত চলতি বছরের জেএসসি-জেডিসির ফল থেকেই সমস্যার সৃষ্টি। আগে চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যোগ করে জিপিএ ৫ নির্ধারণ করা হতো। চলতি বছর থেকে চতুর্থ বিষয়ের নম্বর বাদ দিয়ে জিপিএ ৫ নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সারাদেশে আকস্মিকভাবে জিপিএ ৫ প্রাপ্তি বিপুল সংখ্যায় কমে গেছে। আর এ কারণেই বৃত্তি দেওয়া নিয়েও গোল বেঁধেছে।
গত ২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ সালের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। গতবারের চেয়ে এবার এ দুটি পরীক্ষায় লক্ষাধিক জিপিএ ৫ কমে গেছে। গতবারের চেয়ে এক লাখ ২৩ হাজার ৫৩৩ জন কম পেয়েছে জিপিএ ৫। এবার পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৯ শিক্ষার্থী। পাস করেছে ২২ লাখ ৩০ হাজার ৮২৯ জন। এবার দুই লাখ ১২ হাজার ৫৫৮ শিক্ষার্থী বেশি পাস করেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নীতিমালা সংশোধন করেই জুনিয়র বৃত্তি এ বছর দিতে হবে। এর আগে ২০১৪ সালে নীতিমালা আরেকবার সংশোধন করা হয়েছিল। তখন চতুর্থ বিষয়ের নম্বর বাদ দিয়ে মোট প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে জেএসসিতে বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার আগে জুনিয়র বৃত্তি দেওয়া হতো ফলের ওপর ভিত্তি করে। ২০১৪ সাল থেকে দেওয়া হতো চতুর্থ বিষয় বাদ দিয়ে। ২০১০ সাল থেকে অনুষ্ঠিত জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার ফলের ওপর বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে।
২০০৯ সাল পর্যন্ত মাউশির অধীন অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার অতিরিক্ত পৃথকভাবে জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতো। তবে মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির জন্য পৃথক কোনো বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল না। জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা চালুর পর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও জিপিএ ফলের ওপর ভিত্তি করে সাধারণ ও মেধাবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে।
জেএসসিতে মেধা কোটায় ৯ হাজার ৮০০ ও সাধারণ কোটায় ২১ হাজার এবং জেডিসিতে মেধা কোটায় দুই হাজার ও সাধারণ কোটায় চার হাজার বৃত্তি দেওয়া হয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালের অষ্টম শ্রেণিতে (জেএসসি) ৩০ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৯ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী মেধাবৃত্তি ও ২১ হাজার শিক্ষার্থী সাধারণ বৃত্তি পেয়েছে। মেধাবৃত্তির ক্ষেত্রে প্রতি মাসে ৩০০ টাকা ও বার্ষিক এককালীন ৩৭৫ টাকা এবং সাধারণ বৃত্তির ক্ষেত্রে মাসিক ২০০ টাকা ও বার্ষিক এককালীন ২২৫ টাকা দেওয়া হয়। এ বৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীরা কেবল নবম ও দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নের সময় পেয়ে থাকে।