ইহুদিবাদী ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বহুল আলোচিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র অংশবিশেষ ফাঁস করেছে ইসরাইলি পত্রিকা ‘ইসরাইল হাইয়োম’। পত্রিকাটি দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিতরণ করা নথির বরাত দিয়ে পত্রিকাটি বলছে, এই নথিতে থাকা শর্তাবলীর অংশবিশেষ ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপে উল্লেখও করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাই ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক উপদেষ্টা জারেড কুশনার এবং ইসরাইল বিষয়ক উপদেষ্টা জ্যাসন গ্রিনব্ল্যাট। এই দু জনের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে নেতানিয়াহুর।
ফাঁস হওয়া নথি মোতাবেক, ওই চুক্তি সই হবে ইসরাইল, ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা পিএলও এবং হামাসের মধ্যে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বর্তমানে দখলকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, যার নাম হবে ‘নয়া ফিলিস্তিন’। এক বছরের মধ্যে একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পরবর্তী ৩ বছরের মধ্যে ইসরাইল ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেবে।
এই নথিতে অনেকটাই অস্পষ্ট রয়ে গেছে জেরুজালেম ইস্যুটি। নথিতে বলা হয়েছে, জেরুজালেম এখনকার মতো অবিভক্তই থাকবে। তবে শহরের দায়িত্ব ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। ইসরাইল শহরের সাধারণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনিরা হবেন নয়া ফিলিস্তিনের নাগরিক। জেরুজালেমে ইসরাইলি পৌরসভা শহরের জমি সংক্রান্ত দায়িত্বে থাকবে। নয়া ফিলিস্তিন ইসরাইলি পৌরসভাকে কর দেবে। বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের শিক্ষাদীক্ষার দায়িত্বে থাকবে তারা।
জেরুজালেমে বসবাসরত ফিলিস্তিনির সংখ্যা আনুমানিক ৪ লাখ ৩৫ হাজার। তাদের কাছে ইসরাইলের স্থায়ী নাগরিকত্ব সনদ রয়েছে। শহরের বাইরে নির্দিষ্ট সময় বসবাস করলে ইসরাইল এই সনদ বাতিল ঘোষণা করতে পারে। তারা ইসরাইলের নাগরিকত্বের অধিকার পান না।
জেরুজালেমের পবিত্র নগরীর বিদ্যমান অবস্থা বহাল থাকবে। ইহুদী ইসরাইলিরা সেখানে জমি কিনতে পারবেন না। তেমনি ফিলিস্তিনিরাও জমি কিনতে পারবেন না। অপরদিকে পশ্চিমতীরে থাকা ইসরাইলি বসতি, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অবৈধ ধরা হয়, সেগুলো ইসরাইলের অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাবে।
নথি মোতাবেক, গাজা উপত্যকার জন্য অতিরিক্ত ভূখণ্ড দেবে মিশর। সেখানে বিমানবন্দর, কারখানা, বাণিজ্যিক ও কৃষি কেন্দ্র থাকবে। কিন্তু সেখানে ফিলিস্তিনিরা বসবাস করতে পারবেন না। এ বিষয়ে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বর্তমানে একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে সংযোগের জন্য ইসরাইলের ভেতর দিয়ে মাটি থেকে ৩০ মিটার ওপরে সংযোগ সড়ক নির্মিত হবে। এই মহাসড়কের ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করবে চীন। দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও ইইউ ১০ শতাংশ করে ব্যয় করবে।
ফাঁস হওয়া এই নথিতে ইঙ্গিত মিলছে যে, চুক্তিতে অর্থায়ন করবে আমেরিকা, ইইউ এবং অজ্ঞাত কিছু উপসাগরীয় দেশ। নয়া ফিলিস্তিনে বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে ব্যয়ের জন্য ৫ বছরে তিন হাজার কোটি ডলার দেওয়া হবে। এই অর্থের মধ্যে আমেরিকা ২০ শতাংশ, ইইউ ১০ শতাংশ ও উপসাগরীয় দেশগুলো ৭০ শতাংশ বহন করবে।
নয়া ফিলিস্তিনের কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। শুধু পুলিশ বাহিনী থাকবে। নয়া ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে একটি সুরক্ষা চুক্তি সই হবে। এই চুক্তি অনুযায়ী নয়া ফিলিস্তিনকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে ইসরাইল। বিনিময়ে ইসরাইলকে অর্থ পরিশোধ করবে ফিলিস্তিন। প্রয়োজনে আরব দেশগুলোও ইসরাইলকে অর্থ পরিশোধ করবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, চুক্তি সই হলে হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিজেদের সমস্ত অস্ত্র মিশরের কাছে জমা দেবে। বিনিময়ে হামাস নেতাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে ও মাসিক বেতন দেবে আরব রাষ্ট্রগুলো।
ইসরাইলি টার্মিনাল ও ক্রসিংয়ের মাধ্যমে গাজার সীমান্ত বহিঃর্বিশ্বের জন্য খুলে দেয়া হবে। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি সমুদ্র ও বিমানবন্দর নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি সমুদ্র ও বিমান বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। ফাঁস হওয়া নথিতে বলা হয়েছে, পিএলও এবং হামাস এই চুক্তি সই না করলে তাদেরকে শাস্তি পেতে হবে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা এমন সব প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করবে এবং অন্যদেরকেও বন্ধ করতে বলবে যেখান থেকে ফিলিস্তিনিরা আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকে। যদিও আমেরিকা এরইমধ্যে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা ও জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি হাসপাতালে অর্থায়ন বন্ধ করেছে। যদি পিএলও চুক্তি সই করে, কিন্তু হামাস ও ইসলামি জিহাদ ই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করবে ইসরাইল, যাতে পূর্ণ সমর্থন থাকবে আমেরিকার। অন্যদিকে, ইসরাইল এই চুক্তি সই না করলে, যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে দেয়া সকল আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেবে