চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল এক হাজার ৬৪১ কোটি টাকা। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বাজেট ঘাটতি বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৩ গুণ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা সংক্রান্ত প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধিতে হোঁচট খাওয়াসহ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বৈদেশিক অর্থায়ন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় বাজেট ঘাটতির অন্যতম কারণ। তাই রাজস্ব আহরণের গতি বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। আর গত ছয় মাসে রাজস্ব আহরিত হয়েছে এক লাখ ১৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থবছরের বাকি ছয় মাসে রাজস্ব আহরণ করতে হবে ৬৬ শতাংশ। যা প্রায় অসম্ভব।
সূত্র জানায়, মোট রাজস্বের সিংহভাগ তথা দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা আদায়ে রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। এছাড়া এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা এবং কর বহির্ভূত রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা।
এরমধ্যে প্রথম ছয় মাসে এনবিআর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। আলোচ্য সময়ে এক লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর আদায় করছে ৯৭ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।
তবে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আদায় বেড়েছে সাড়ে পাঁচ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, আমদানি শুল্ক ও স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আদায়ে বেশি পিছিয়ে এনবিআর।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, গত ছয় মাসে ৪০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আমদানি শুল্ক আদায় হয়েছে ৩০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে শুল্ক আদায় হয়েছিল ২৯ হাজার ৭১২ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ছয় মাসে শুল্ক আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৭২ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে শুল্ক আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ শতাংশের বেশি।
গত ছয় মাসে ৫০ হাজার ২৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছিল ৩৬ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। পূর্বের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে গত ছয় মাসে আদায় বেড়েছে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। অথচ গত অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২০ শতাংশ।
এ দুটি খাতের চাইতে আয়কর আদায়ে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেশি, যা প্রায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে আয়কর খাতেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কম হয়েছে প্রায় পৌনে সাত হাজার কোটি টাকা। এ সময়ে আয়কর খাতে রাজস্ব আয় হয়েছে ২৮ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। ফলে এ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়।
- আরও পড়ুন>> ঋণগ্রহীতা শনাক্ত করতে আসছে ‘বিন’
তবে গত ছয় মাসে রাজস্ব আদায় এত কমে যাওয়ার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, নির্বাচনের সময় হওয়ায় রাজস্ব আদায়ে কিছুটা প্রভাব পড়ে। কিন্তু রাজস্ব এত কমে যাওয়ার কারণ বোধগম্য নয়। হঠাৎ করে তো এনবিআরের দক্ষতাও কমে যাওয়ার কথা নয়। অবশ্য নির্বাচনকে সামনে রেখে কিছু খাতে কর ছাড় একটি কারণ হতে পারে। এছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি বাড়ছে কিনা কিংবা অন্য কোনো উপায়ে ভ্যাট ট্যাক্স ফাঁকি রোধ করতে এনবিআরের তদারকি বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন তিনি।
সম্প্রতি মাসগুলোতে এনবিআরের রাজস্ব আদায় এত কম হওয়ায় রাজস্ব বোর্ডেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে রাজস্বেও গতি মন্থরতার কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে এনবিআরের কাছে। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ার কারণ খোঁজার চেষ্টা করছে এনবিআরও। এ নিয়ে কয়েক দফা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া।
এদিকে এনবিআর বহির্ভূত কর রাজস্ব আহরণে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রথম ছয় মাসে আহরণ হয়েছে মাত্র তিন হাজার ৭১১ কোটি টাকা। যা কি-না গত বছরের একই সময়ের চেয়ও ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কম। গত বছর একই সময়ে এ খাতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল তিন হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা।
এছাড়া কর বহির্ভূত রাজস্ব আহরণে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৪ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। যা এ খাতে মোট লক্ষ্যমাত্রার ৪৩ শতাংশ।
বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিষয়ে গত বুধবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বাজেট প্রণয়নে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ। রাজস্ব আহরণ করতে হবে। তারপর প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
চলতি অর্থবছরে বাজেটে মোট ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরমধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৪২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। আর ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা।
এছাড়া বৈদেশিক উৎস থেকে ৫৪ হাজার ৬৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বৈদেশিক অর্থায়ন কমে প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে যেখানে বৈদেশিক অর্থায়ন এসেছিল ছয় হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এবার প্রথম ছয় মাসে সেখানে এসেছে মাত্র তিন হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা বলেন, প্রতিবছরই দেশের মোট জিডিপির ৫ শতাংশহারে ঘাটতি রেখে বাজেট দেয়া হয়। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নের হার ভালো না হওয়া অর্থ মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতে পারে না। তাই শেষ পর্যান্ত এ পরিমাণ আর বাজেট ঘাটতি থাকে না।