সুবীর নন্দী, শোক, সেলিব্রেশন ও অন্যান্য

ইমরুল হাসান

জন্মানোর মতন মরণও সেলিব্রেশনের একটা ঘটনা।এইটা পয়লা টের পাইছিলাম একবার চিটাগাঙে মেজবান খাইতে গিয়া। যিনি মারা গেছেন (হইতে পারে পিসফুল একটা ডেথ ছিল তার), তার রিলেটিভরা খুব আদর কইরা খাওয়াইতেছিলেন মানুষদেরকে, সমাদর করতেছিলেন; এমন একটা ব্যাপার ছিল যেন সবাই খাওয়াদাওয়া কইরা যে খুশি হইতেছে, এইটাতে মরা মানুষটার আত্মাও যেন শান্তি পাইতেছে। এইরকম একটা স্যাটিসফেকশনের ব্যাপার আমি ফিল করছিলাম।

এখন, একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরে তারে নিয়া ভালো জিনিসগুলা মনে করে মানুষজন, এইভাবে তার মইরা যাওয়াটা না, বরং উনি যে বাঁইচা ছিলেন, তার একটা সেলিব্রেশন হইতে থাকে। উনি নাই, কিন্তু উনি তো ছিলেন! আমরা যখন বাঁইচা আছি, আমরা তো তার কথা কইতে পারি। আমরা মারা গেলে আমাদের কথা কেউ কইব — এইরকম কোনো এক্সপেক্টেশন থিকা না মনেহয়, বরং মইরা যাওয়াটা তো একটা অকেশন, আমাদের বাঁইচা-থাকা জীবনে।

universel cardiac hospital

২.
ব্যাপারটা এইরকম না যে, একরকমের রিভাইব হয়, বাঁইচা উঠেন আবার মানুষটা। কিন্তু উনি যে বাঁইচা ছিলেন, সেই ব্যাপারটা আবার বলাবলির ভিতর দিয়া একভাবে ডকুমেন্টেড হইতে শুরু করে। আরেকবার হারায়া যাওয়ার আগে, সবসময়ের জন্যে; রিফ্লেকশন হয় একটা।

৩.
আসলে তো সুবীর নন্দী মারা গেছেন বইলা এইসব কথা মনে হইল আবার নতুন কইরা। একইসাথে পুরান আরেকটা জিনিসও মনে হইল; যে, আর্টের মালিক আসলে কেডা? খালি ফিন্যানশিয়্যাল অর্থে না, পাবলিকের মনেও। যেমন, ‘পাখি রে তুই…’ গানটা; ১৯৮৫ সালের ‘লাল গোলাপ’ সিনেমার গান। লিরিকটা খান আতাউর রহমানের আর সুর হইতেছে আমির আলীর। সিনেমার নায়ক-নায়িকা হইতেছেন জসিম আর অঞ্জু ঘোষ। সিনেমার ডিরেক্টর ছিলেন সি.বি. জামান। (ইউটিউবের একটা লিংকে এই ইনফরমেশনগুলা পাইলাম।)

এখন, এই গানটা কিন্তু খান আতাউরের গান হয় নাই বা আমির আলীর। জসিম বা অঞ্জুরও না। (জসিম বা অঞ্জুর না হওয়াতে বরং এখন ‘আর্ট’ হইতে পারতেছে আমাদের কাছে, যখন এত বছর পরে ওই ভিজ্যুয়ালটা ফেড-আউট হওয়ার পরে।) হইছে সুবীর নন্দীর গান। হিন্দিতে, অনেক গান কিন্তু গুলজারের (পোয়েট, লিরিসিস্ট), এ.আর. রহমানের (মিউজিশিয়ানের), সিঙ্গারের তো হয়ই এমনিতে।

শেক্সপিয়রের আমলে নাকি এইরকম ছিল, কে লিখছেন — সেইটা ঘটনা ছিল না; নাটক ছিল কোম্পানির নামে, যারা করত নাটকটা। মানে, মালিক তো প্রডিউসাররাই, কিন্তু একটা গ্রুপওয়ার্কে একজনরে মনে রাখি তো আমরা। তো, আমাদের টাইমে আমরা যেমনে আর্টের বিচার করি তাতে একটা ‘সিগনেচারের’ ঘটনা থাকে মনেহয়; যে, একজন আর্টিস্টের যে টাইপ, সেইটা উনি কতটা ইনসার্ট করতে পারলেন আর্টটার মধ্যে।

সুবীর নন্দীর গান গাওয়ার একটা স্টাইল আছে, সেইটা প্রমিনেন্ট মেবি; আবার চোখের সামনে যতবার সুবীর নন্দীরে গান গাইতে দেখছি, খান আতার নাম তো শুনি নাই তত; জসিম আর অঞ্জুরে তো দেখিই নাই। ভিজিবিলিটির একটা ঘটনা এইখানে আছে। আর এইটা রেন্ডম কোনো ঘটনা মনেহয় না, কিছু ক্রাইটেরিয়া এইখানে কাজ করে; যেইভাবে আমরা মনে রাখি বা ভুইলা যাই।

৪.
“যদি কোনোদিন আমার পাখি আমায় ছেড়ে দূরে চলে যায় / একা একা রবো নিরালায়…”

মরার পরটা এইরকম একটা নিঃসঙ্গতা আসলে। কিছু মেমোরি হিসাবে থাকতে থাকা, মানুষের মনে। যেই মানুষগুলা মনে রাখবে তারা মরার পরেই আমরা মারা যাইতে পারি পুরাপুরি বা অন্য কোনো-একটা ফর্মে বা ফর্ম্যাটে হয়তো থাকতেই থাকি, আননেসেসারি কোনো ডাস্ট হয়া, এই ইউনিভার্সে। নিরালায়।

লেখক পরিচিতি:

ইমরুল হাসান

জন্ম: ১৯৭৫। কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক ও অনুবাদক। বসবাস করেন ঢাকায়। প্রকাশিত বই: কালিকাপ্রসাদে গেলে আমি যা যা দেখতে পাবো (কবিতা, ২০০৫), অশ্বত্থ বটের কাছে এসে (কবিতা, ২০১০), রাঙামাটি (কবিতা, ২০১২), স্বপ্নের ভিতর (কবিতা, ২০১৩), বসন্ত ১৪১৯ (২০১৫), পুরির গল্প (গল্প, ২০১৬), টেস্ট এনভায়রনমেন্ট (কবিতা, ২০১৬), রুমির কাহিনি (অনুবাদ, ২০১৭), ‘ধান কাটা হয়ে গেলে পরে…’ (কবিতা, ২০১৭), মিথ্যাবাদী রাখাল (২০১৮)।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে