এলিজি এবং সে

মিনার মনসুর

তাকে আসতেই হয়

সে তো আসবেই। যদি না আসতো কুষ্ঠরোগীর মতো কি খসে পড়তো না অরণ্যের অনাঘ্রাত স্তনের মাদকতা? কামার্ত বালিয়াড়ির অষ্টবাহুর তাণ্ডবে কি দম বন্ধ হয়ে আসতো না জলপরিদের? বাংলামতি ধানের শীষে ভৌতিক বাদুড়ের মতো কি ঝুলে থাকতো না অগণিত অদম্য কৃষকের খুলি?

universel cardiac hospital

অবশ্য যারা বলে তোমার দেহনির্গত বর্জ্যে পৃথিবীর প্রাণ ওষ্ঠাগত- তাদের হিসাব আলাদা। পিঁপড়ের মুখের চিনির দানাটিও তাদের চকচকে চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না; অথচ ইঁটভাটার মতো কর্কশ হৃদয় থেকে নিরন্তর যারা ঘৃণার আলকাতরা উদ্গীরণ করে চলেছে- সে বিষয়ে তারা শিশুর মতো সরল।

বস্তত তারা পাথর সঞ্চয় করে। প্রাসাদ বানায়। রূপসীর ত্বকের মতো স্বচ্ছ আর গ্রীবার মতো উদ্যত। তার আয়নায় নিয়ত নিজের চর্বিবহুল গর্বিত অবয়ব দ্যাখে। আর পরিযায়ী পাখির ডানায় চেপে যে-গান পৃথিবী পরিভ্রমণ করে; মেরু-ভল্লুকের তুষারাবৃত আলস্য এনে ভাসিয়ে দেয় হাকালুকি হাওড়ের উষ্ণ জলে- তাকে তারা পাথরচাপা দিয়ে রাখতে চায়।

তখনই মত্ত হাতির মতো সব লণ্ড-ভণ্ড করে সে আসে। তাকে আসতেই হয়।

এলিজি

সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

ভরা বাদর          মাহ ভাদর

        শূন্য মন্দির মোর॥

বিদ্যাপতি

কেঁদেও পাবো না তোমাকে বর্ষার অজস্র জলধারে-সে আমি জানতাম। আমার মন্দির তবু কানায় কানায় পূর্ণ ছিল তোমার শূন্যতায়। অকস্মাৎ সেই শূন্যতাটুকুও কেড়ে নিলে তুমি!

আমাকে ছেড়ে গ্যাছো তাতে কী! তোমার ভেতরে তো ছিলে তুমি। বিপন্ন ধরিত্রীর আলো-হাওয়ায় মিশেছিল তোমার আশ্চর্য সজীব নিঃশ্বাস। আষাঢ়ের বৃষ্টিস্নাত প্রথম কদম ফুলে আমি তোমাকে দেখতাম। এই আষাঢ়েই তুমি তোমাকেও ছেড়ে চলে যাবে দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি আমি।

তোমাকে নিয়ে এটাই আমার শেষ শোকগাথা কি না জানি না। সিসিফাসের মতো আমিও তো পাথরের বুকে সেই একই কবিতা খোদাই করে চলেছি অবিরাম। নিজেকে নিয়ে কী আর ভাববো? আমার হৃদয় সে তো এক পরিত্যক্ত নগরী। তার আর কীই-বা আছে হারাবার!

আমার সব কান্না তো তুমি সঙ্গে করে নিয়ে গেছো আগেই। আমার চোখ জলশূন্য বহুদিন। তাতে কী, আষাঢ়ের আকাশে আজ অন্তহীন জলের প্লাবন। আকাশ কাঁদুক।

লেখক পরিচিতি:

মিনার মনসুর

লেখালেখির শুরু সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে। মূলত কবি। জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালে, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিএ (সম্মান) এবং এমএ পাস করেছেন যথাক্রমে ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে। বর্তমানে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক। তার প্রকাশিত বই দশের অধিক। সম্পাদনাও করেছেন বেশ ক’টি সংকলন। ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৯) তার আলোচিত সম্পাদনা গ্রন্থ।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে