উদ্ধার হচ্ছে না জনতা ব্যাংকের ১০ হাজার কোটি টাকা

বিশেষ প্রতিনিধি

শীর্ষ আট ঋণখেলাপির কাছে আটকে আছে রাষ্ট্রীয় খাতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক জনতা ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু দুটি গ্রুপের কাছেই ব্যাংকটির পাওনা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।

এই বিশাল অঙ্কের ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকটির ডিএমডি ও জিএমদের সমন্বয়ে একটি ‘বিশেষ মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এই ১০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ থেকে কতখানি আদায় করা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

universel cardiac hospital

সূত্র জানায়, গত কয়েক বছর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই ঋণগুলো দেওয়া হয়েছে। জনতা ব্যাংকের শীর্ষ আট ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটি গ্রুপ ২০১৮ সালে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে।

জনতা ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ আট ঋণখেলাপির মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে ‘এ্যানটেক্স গ্রুপ’। বহুল আলোচিত এই গ্রুপের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এই কোম্পানির কাছে জনতা ব্যাংকের আটকে আছে ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা।

এই দুটি গ্রুপই আবার একই মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, যারা সম্পূর্ণ প্রতারণা ও তৎকালীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সহায়তায় এই বিশাল অঙ্কের ঋণ অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান থাকার সময় সম্পূর্ণ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশাল অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে, যার পুরোটাই কয়েক বছর ধরে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়ে আছে।

জনতা ব্যাংকের তৃতীয় শীর্ষ ঋণ খেলাপি হচ্ছে ‘গ্রাম বাংলা এনপিকে’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এর কাছে ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৩১২ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে ‘জনকণ্ঠ গ্রুপ’। জনকণ্ঠ গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২২৯ কোটি টাকা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আফিল জুট মিলস। এদের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা ১৩৭ কোটি টাকা। পারটেক্স গ্রুপের কাছে রয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। এ্যাপেক্স গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা এবং অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা রয়েছে আরো ৯২২ কোটি টাকা।

বিশাল এই খেলাপি ঋণ উদ্ধারে জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ নেওয়া হয়েছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ বিষয়ে জনতা ব্যাংকের ভাষ্য হচ্ছে, ‘ঋণ আদায়ে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে বাস্তবতার আলোকে প্রয়োগযোগ্য অ্যাকশন প্ল্যান-২০১৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের সব স্তরের নির্বাহী এবং কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। শাখা পর্যায় থেকে এরিয়া অফিস ও বিভাগীয় কার্যালয়গুলোর জন্য টার্মস অব রেফারেন্স এবং রিপোর্টিং ফর্ম দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক স্তর থেকে নির্ধারিত ছকে মাসিক ভিত্তিতে গ্রাহকওয়ারি আদায় অগ্রগতি প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহীরা আদায় অগ্রগতি পর্যালোচনা-তদারকি করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন।’

জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইতোমধ্যে ব্যাংকটি ১২০০ কোটি টাকার শ্রেণিকৃত ঋণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও ৩৬৫ কোটি টাকা নগদ আদায়ও সম্ভব হয়েছে।

এদিকে, বৃহৎ দুটি ঋণখেলাপি গ্রুপের বিষয়েও জনতা ব্যাংকের একটি ভাষ্য পাওয়া গেছে। ভাষ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট গ্রুপের কাছে ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ইতোমধ্যে পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ব্যাংক ঋণগ্রহীতার মজুদ মালামাল/গোডাউন পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে তদারকি করা হচ্ছে। ৬৬১ কোটি টাকার মজুদ মালামাল অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বিক্রির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আদালতের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতার সম্পত্তি বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, এ্যানটেক্সের বিষয়ে জনতা ব্যাংকের বক্তব্য হচ্ছে, সিইও ও এমডির নেতৃত্বে ডিএমডিকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তারা প্রতিনিয়ত ঋণগ্রহীতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছেন। ঋণ পরিশোধে তিন মাসের সময় দিয়ে গ্রাহককে তাগিদপত্র দেওয়া হয়েছে। গ্রাহক ঋণ পরিশোধে এগিয়ে না এলে চূড়ান্ত নোটিশ দিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জনতা ব্যাংকের এই ঋণগুলোর বেশিরভাগই অনিয়মের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, কোনোরূপ যাচাই-বাছাই না করে পরিচালনা পর্ষদ টপ দুই ঋণখেলাপিকে ঋণ দেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে। এই ঋণগুলো এখন আর আদায় করা সম্ভব হচ্ছে না। আদতে এই ঋণ আদায় করা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত চেয়ারম্যান থাকার সময় জনতা ব্যাংক এসব ঋণ দিয়েছিল। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত এমডি ছিলেন এস এম আমিনুর রহমান। তাদের সময়েই এসব অর্থায়ন হয়েছে।

উল্লেখ্য, খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত রাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই ব্যাংকটির অবস্থা এখন খুব খারাপ। সূচনার পর এখনই সবচেয়ে বাজে সময় পার করছে ব্যাংকটি। ফলে শুধু এক বছরের ব্যবধানে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিন গুণ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৮১৮ কোটি। এক বছরের ব্যবধানে গত বছর (২০১৮) ডিসেম্বরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ফলে এক বছরেই জনতার খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে