চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রকৃত আমদানিকারকরা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হলেও অসাধু আমদানিকারকরা ঠিকই মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য এনে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছেন- এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, কাস্টমসের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটা অঙ্কের টাকায় ‘ম্যানেজ’ করেই এটি করছে অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র।
শুল্ক গোয়েন্দা দফতর ও কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখা বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের চালান আটক করলেও বেশির ভাগ চালান ছাড় হয়ে যাচ্ছে। কম শুল্কের পণ্য ঘোষণা দিয়ে বেশি শুল্কের পণ্য নিয়ে এসে চক্রটি কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছে। অনেক সময় আমদানিনিষিদ্ধ পণ্যও আনা হচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে সিগারেট, বিদেশি মদ, ইত্যাদি। দুই মাসে এ ধরনের তিন শতাধিক চালান ধরা পড়েছে। শুধু তাই নয়, পণ্যের নামে ইট-বালু নিয়ে এসে অর্থ পাচারের ঘটনাও ঘটছে।
সংশ্লিষ্টদের আরও অভিযোগ, চোরাকারবারি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য অমাদানিতে উৎসাহিত করে এবং পণ্য ছাড়ের ব্যবস্থা করে কাস্টমসের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক বনেছেন। এই শুল্ক স্টেশনে যোগ দিয়েই টাকা বানানোর নেশায় মত্ত হয়ে উঠেন অনেকে।
মানা হচ্ছে না নিয়ম-নীতি:
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে তারা প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানা অজুহাতে হয়রানি করলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা ঠিকই পার পেয়ে যাচ্ছেন। পৃথক সংস্থার অভিযানে মিথ্যা ঘোষণায় আনা কিছু কিছু পণ্যের চালান আটক হচ্ছে।
জানা গেছে, গত দুই মাসে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা ৩০৩টি পণ্যের চালান আটক করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিচার্জ (এআইআর) শাখা। চট্টগ্রাম বন্দরে শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় এসব চালান ধরা পড়ে। আটক চালান থেকে অর্ধশত কোটি টাকা শুল্ক ও জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার-১ মোহাম্মদ আকবর হোসেন বলেন, ‘মিথ্যা ঘোষণায় আনা কোনো পণ্য চালান যাতে বন্দর থেকে বের হয়ে যেতে না পারে, কেউ যাতে শুল্ক ফাঁকি দিতে না পারে সে ব্যাপারে তারা সদা সতর্ক রয়েছেন।
কাস্টমসের এআইআর শাখা এবং শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগও তৎপর রয়েছে। তৎপরতার কারণেই ধরা পড়ছে মিথ্যা ঘোষণায় আনা পণ্যের চালান। তিনি আরও বলেন, দু’মাসে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেছে কাস্টমসের এআইআর শাখা। অভিযানে তিন শতাধিক পণ্য চালান ধরা পড়েছে। এসব চালান থেকে ৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত শুল্ক ও ১০ কোটি টাকারও বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, জাভেদ ট্রেডিং কোম্পানি নামে ঢাকার তেজগাঁওয়ের একটি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ১৬০ পিস ‘ইলেকট্রনিক মোটর’ ঘোষণা দিয়ে নিয়ে আসে ‘বল বিয়ারিং’। শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি ধরা পড়ে। এই চালানে ৫৭ লাখ ৪২ হাজার ৯৫৭ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়া হয়। পরে জরিমানাসহ এ প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় করা হয় ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৬৪১ টাকা।
আসাদ অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান ৬ হাজার ৭০০ কেজি স্ক্র্যাপার (হাঁড়ি-পাতিল মাজনি) ঘোষণা দিয়ে নিয়ে আসে ১৩ হাজার ৮০৮ দশমিক ১৬ কেজি প্লেয়িং কার্ড বা তাস। এই চালানে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা হয় ৬০ লাখ টাকা।
কায়িক পরীক্ষায় মিথ্যা ঘোষণার বিষয়টি ধরা পড়ার পর এই টাকা আদায় করা হয় জরিমানাসহ। র্যাংগস ইলেকট্রনিক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান র্যাংগস ব্র্যান্ডের বিভিন্ন স্ক্রিন সাইজের মোবাইল ফোন নিয়ে আসে। কিন্তু তাদের চালানে ঘোষণাবহির্ভূত এবং অতিরিক্ত পণ্য পাওয়া যায়। এতে ৮৮ লাখ ২৪ হাজার ১৮৫ দশমিক ৬৫ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা হয়।
এভাবে লালখান বাজার চট্টগ্রামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকা মদনপাল লেনের সানরাইজ ইন্টারন্যাশনাল, কেরানীগঞ্জের সিদ্দিক অ্যান্ড কোং, চট্টগ্রামের মেহেদীবাগের পিটুপি, জুবিলি রোডের মডার্ন ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ, ঢাকার নবাবপুরের জিএস পাওয়ার, সিমসন রোডের কল্পনা এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্ন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৩০৩টি পণ্য চালানে কায়িক পরীক্ষায় শুল্কের ব্যাপক হেরফের ধরা পড়ে। ফাঁকি দেয়া শুল্ক ও জরিমানা দিয়েই তাদের পণ্য ছাড় করতে হচ্ছে।
এর আগে আরও বেশ কিছু বড় বড় চালান আটক করা হয়। চীন থেকে মিথ্যা ঘোষণায় প্রতিষ্ঠান কাটিং ব্লেড ঘোষণা দিয়ে পলিশড স্টিল স্ট্রাইপ ও ব্রাশ স্ট্রাইপ কয়েল নিয়ে আসে। এতে প্রায় ৮৫ লাখ টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করা হয়। গত বছরের শেষের দিকে এই চালানটি আটক হয়।
চালানটি খালাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএন্ডএফ প্রতিষ্ঠান ছিল উজালা শিপিং লাইন্স লিমিটেড। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল সুফলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। ব্র্যান্ড নিউ প্রিন্টিং মেশিন ঘোষণা দিয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নিয়ে আসে দুটি ব্র্যান্ডের ৬ লাখ ৩০ হাজার সিগারেটের প্যাকেট। যেখানে ১ কোটি ৩০ লাখ শলাকা পাওয়া যায়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ফোমজাতীয় পণ্যের ঘোষণা দিয়ে বিপুল পরিমাণ এই সিগারেট নিয়ে আসে।
‘৩০৩’ ও ‘মন্ড’ ব্রান্ডের এসব সিগারেটের বাজার মূল্য ছিল ১৩ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে শুল্ক-কর ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা হয় ৯ কোটি টাকা। ঢাকার পুরানা পল্টনের গ্রাম বাংলা কর্পোরেশন মিথ্যা ঘোষণায় এই সিগারেট আমদানি করে।