হালদায় চলছে নির্বিচারে মা মাছ নিধন

সারাদেশ ডেস্ক

হালদা নদী
হালদা নদী

গত ৫ মে হালদা নদীতে মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছে। এখন বজ্রসহ প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের তোড়ে নদীতে কার্প জাতীয় মা মাছ যে কোনো সময় ডিম ছাড়তে পারে। হাজারো ডিম আহরণকারীরা যখন সে মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় ঠিক তখনই মৎস্য নিধনকারীদের একটি চক্র বিভিন্ন উপায়ে নদী থেকে মাছ নিধন করে চলেছে।

চক্রটি গত দু’মাসে নদী থেকে বিভিন্ন উপায়ে অন্তত ৩৫টি কার্প জাতীয় মাছ নিধন করেছে।

একই সময় নদীতে ইঞ্জিনচালিত জলযানের প্রপেলারের আঘাতে মরে ও পঁচে ভেসে উঠেছে ৯টি মা মাছ। অথচ মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ অনুসারে হালদা নদীর নাজিরহাট ব্রিজ থেকে কালুরঘাট ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে সরকার মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে।

 নজরদারির দু‘জন আনসার সদস্য

মাছের এই অভয়াশ্রমে সারাবছর যে কোনো উপায়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। প্রজননের মৌসুম মার্চ থেকে শুরু করে জুলাই পর্যন্ত নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলও নিষিদ্ধ।

অথচ সবকিছু নজরদারির জন্য নদীর বিশাল এ অংশে মাত্র দু’জন আনসার সদস্য নিয়োগ করেছে মৎস্য বিভাগ। প্রশাসনিক এ দুর্বলতার সুযোগে নির্বিচারে বিভিন্ন উপায়ে মৎস্য নিধন, ইঞ্জিনচালিত জলযান চলাচল ও চট্টগ্রাম নগরীর সুপেয় পানির উৎস এ নদীকে বিভিন্ন উপায়ে দূষিত করে তোলা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে- হালদা নদী কি মা মাছের অভায়াশ্রম, নাকি মরণফাঁদ হয়ে উঠছে?

৫০ মৎস্যলোভী চক্রের মাধ্যমে চলছে মা মাছ নিধন

সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অন্তত ৫০ এর অধিক মৎস্যলোভী হালদায় প্রতিদিন বড়শি, ঘেরা জাল, কারেন্ট জাল, হাত জাল- এমনকি বিষ প্রয়োগ করে নির্বিচারে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য নিধন করছে। নিধনকৃত মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউস, বোয়াল, আইড়, বাইনমাছ ছাড়াও ছোট বড় চিংড়ি ও বিভিন্ন প্রজাতি মাছ রয়েছে। 

নদীর উজানের ধলই ইউনিয়নের শীলের ঘাটা এলাকা থেকে নাঙ্গলমোড়া স্কুল সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে নদীতে মৎস্য নিধনকারী চক্রকে অন্তত ২৭টি ঘেরা জাল পাততে দেখা গেছে। এ স্পটে চলাচল করছে বালুবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকাও। 

ঘেরা জাল বসানোর সময় মৎস্য নিধনকারী ফটিকছড়ি উপজেলার সরোয়ারের (৩০) সঙ্গে বলে জানা যায়, তারা অনেকেই মাছ ধরে ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা জাল বসিয়ে চিংড়ি ও ছোট জাতের কার্প জাতীয় মাছ ধরলেও বড় মাছ নিধন করেন না। 

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েকজন যুবক জানান, ছিপাতলী এলাকায় গত রোববার রাতে মতি ও মমতাজ নামের দুই ব্যক্তি ঘেরা জাল বসিয়ে ৭ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ ধরেন। একইভাবে ধলই বংশাল এলাকায় সপ্তাহখানেক আগে মৎস্য নিধনকারীরা  ৮ কেজি ওজনের একটি রুই মাছ নিধন করেন। এভাবে গত দুই মাসে নদী থেকে অন্তত ৩৫টি বড় জাতের কার্প জাতীয় মাছ ধরেছে মৎস্য নিধনকারীরা। 

সূত্র মতে, হালদা নদীর পাড় ঘেঁষা হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও রাউজান অংশের কিছু ব্যক্তি মাছ নিধনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে ফরহাদাবাদ বংশাল এলাকা থেকে নাঙ্গলমোড়া এলাকার মধ্যে জাকের, সালাউদ্দিন, ইয়াছিন, বাবুল, অহিদ, রাশেদ, ইয়াকুব, জাহাঙ্গীর; ছিপাতলী এলাকায় মতি, মমতাজ, শফি, দুল্লাহ, আলমগীর, আবছার, করিম, গিয়াস, জসিম, কালো নাজিম, ধলা নাজিম; গড়দুয়ারা ও মাদার্শা এলাকায় ফখরুল, জহুর আহম্মদ, ইলিয়াছ, হাসেম, মফিজ, বাহাদুর, জাকির, রাখাল জলদাশ, মনোরঞ্জন জলদাশ, আলী আকবরের নাম জানা গেছে। 

এদিকে হালদা নদীকে মাত্র দু’জন আনসার দিয়ে পাহারা দেওয়ার বিষয়ে স্থানীদের অনেকেই আক্ষেপ করে জানান, যেখানে দারোয়ান দিয়ে একটি দিঘী পাহাড়া দেওয়ার পরও মাছ চুরি হয় সেখানে সুবিশাল হালদা নদীতে মাত্র দু’জন আনসার সদস্য কিভাবে মাছ চুরি বন্ধ করবে? 

হালদা নদী

নদী থেকে মাছ নিধন ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলের কথা স্বীকার করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা মো. আজহারুল আলম বলেন, দুই উপজেলায় কর্মকর্তাসহ ১২ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জন আছি। প্রজননের মৌসুমে দু’জন আনসার দেওয়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের একটি ইঞ্জিনচালিত জলযান থাকলেও সেটি অচল। তারপরও স্বল্প জনবল ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় হালদায় মৎস্য নিধন বন্ধে সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছি। 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা নদী গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদা নদীতে প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে মৎস্য নিধন অব্যাহত রয়েছে। হাটহাজারীর মতো ফটিকছড়ি ও রাউজান উপজেলা প্রশাসন একযোগে কাজ করে নদীতে ইঞ্জিনচালিত জলযান বন্ধ ও মৎস্য নিধনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে নদীতে মা মাছের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকবে। এতে করে নদীতে মাছের আকালসহ নদীর ইকোসিস্টেমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রুহুল আমিন বলেন, হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন এককভাবে নদীতে ৪৫টি অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ১০ হাজার মিটার জাল ধ্বংস করেছে। এছাড়া বালি উত্তোলনের ৫টি ড্রেজার, ৬টি নৌযান ধ্বংস ও দু’জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। স্থানীয়রা এগিয়ে না এলে শুধু প্রশাসিনক নজরদারি দিয়ে হালদা নদী থেকে মৎস্য নিধন বন্ধ করা সম্ভব হবে না বলেও মন্তব্য তার।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে