রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মিত ভবনে আসবাবপত্র কেনা ও ফ্ল্যাটে তোলার ব্যয়ে ৩৩০টি তোশক কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১৯ লাখ টাকা। একই অবস্থা অন্য গুলোর ক্ষেত্রেও। প্রকল্পের আসবাবপত্র কেনার নথিপত্র পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি আসবাপত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয়ের এমন অসংঙ্গতির ঘটনা ঘটিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাবনা জেলার পূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে জানা গেছে, সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা এই প্রকল্পের আওতায় মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে হচ্ছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রেটির কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য ২০ তলা ১১টি ও ১৬ তলা আটটি ভবন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২০ তলা ৮টি ও ১৬ তলা একটি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
আরো জানা যায়, প্রতিটি ২০ তলা ভবনে ১১০টি ও ১৬ তলা ভবনে ৮৬টি ফ্ল্যাট থাকবে। নির্মাণ হওয়া নয়টি ভবনের ৯৬৬টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাবপত্র কেনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২০ তলা একটি ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কেনা ও তা ভবনে ওঠাতে সব মিলে ব্যয় হয়েছে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা। যা অস্বাভাবিক!
নথিপত্র গুলো পর্যালোচনায় আরও দেখা যায়, ২০ তলা ওই ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের জন্য ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকা করে ১১০টি টেলিভিশন ক্রয় করা হয় ৯৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকায়। আর সেগুলো ফ্ল্যাটে ওঠানোর খরচ দেখানো হয় ৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ৯৪ হাজার ২৫০ টাকায় ১১০টি ফ্রিজ ক্রয় করা হয় ১ কোটি ৩৬ লাখ সাড়ে ৭ হাজার টাকায়। সেগুলোর প্রতিটি ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ১২ হাজার ৫২১ টাকা। তাহলে ফ্রিজ ওঠাতে মোট খরচ ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৩১০ টাকা।
একইভাবে ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা দরে মোট এক কোটি ৫০ লাখ টাকায় ক্রয় করা ১১০টি ওয়াশিং মেশিন ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। ৩৮ হাজার ২৭৪ টাকা দরে কেনা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ৬ হাজার ৮৪০ টাকা করে। প্রতিটি কেটলি ৫ হাজার ৩১৩ টাকা দরে কিনে ভবনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। প্রতিটি ইলেক্ট্রিক আয়রন কেনা হয়েছে ৪ হাজার ১৫৪ টাকায়, ওপরে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা করে। প্রতিটি চুলা ক্রয় করা হয় ৭ হাজার ৭৪৭ টাকায় আর তা ওঠানোর খরচ দেখানো হয় ৬ হাজার ৬৫০ টাকা।
প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য ৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকায় ১১০টি খাট ক্রয় করা হয় ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭০ টাকা ব্যয়ে। আর প্রতিটি খাট ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ১০ হাজার ৭৭৩ টাকা। একেকটি সোফা ক্রয় করা হয় ৭৪ হাজার ৫০৯ টাকায়, আর তা ওঠাতে খরচ হয় ২৪ হাজার ২৪৪ টাকা করে। ১৪ হাজার ৫৬১ টাকায় ক্রয় করা প্রতিটি সেন্টার টেবিল ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ২ হাজার ৪৮৯ টাকা।
ছয়টি চেয়ারসহ ডাইনিং টেবিলের একেকটি সেট ক্রয় করা হয় ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৪ টাকায়, আর প্রতিটি ডাইনিং টেবিল ওঠানোর খরচ দেখনো হয় ২১ হাজার ৩৭৫ টাকা। ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা দরে ওয়ারড্রব কিনে ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ১৭ হাজার ৪৯৯ টাকা। ৩৬ হাজার ৫৭ টাকা দরে ৩৩০টি মেট্রেস ও তোশক ক্রয় করা হয় ১ কোটি ১৯ লাখ টাকায়, যা প্রতিটি ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ৭ হাজার ৭৫২ টাকা করে।
৫ হাজার ৯৫৭ টাকা দরে এক হাজার ৩২০টি বালিশ কেনার পর প্রতিটি ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ৭৬০ টাকা। ৩৩০টি বিছানার চাদরের প্রতিটি ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা দরে ক্রয় করে এবং ওঠানো খরচ দেখানো হয় ৯৩১ টাকা। এক লাখ ৯৪ হাজার ৬৬৯ টাকা ব্যয়ে কেনা একটি কনফারেন্স টেবিল ভবনে ওঠাতে ব্যয় করা হয় ১৬ হাজার ৯১০ টাকা। এর একেকটি চেয়ার ভবনে ওঠাতে খরচ হয় তিন হাজার ৬৪৮ টাকা। ৪৫ হাজার ৭৯১ টাকা দরে ক্রয় করা প্রতিটি মিনি কেবিনেট ওঠাতে খরচ হয় ৭ হাজার ৭৫২ টাকা। ৩৩০টি বেডসাইট টেবিলের প্রতি ক্রয় করতে খরচ করা হয় ১১ হাজার ৭৫৬ টাকা এবং এর প্রতিটি ওঠাতে খরচ হয় ১ হাজার ৫০১ টাকা।
এছাড়াও, ৩৫ হাজার ৭৫৭ টাকা দরে ৩৩০টি ড্রেসিং টেবিল ক্রয় করা হয়,যার প্রতিটি ওঠাতে ৮ হাজার ৯১১ টাকা খরচ দেখানো হয়। আয়রন টেবিল ২০ হাজার ৪৫৮ টাকা দরে কিনে প্রতিটি ওঠাতে খরচ দেখানো হয় ২ হাজার ৬৭৯ টাকা। ৮ হাজার ৩১৩ টাকা দরে মিনি সেন্টার টেবিল ক্রয় করে ওঠাতে খরচ হয় ২ হাজার ১৪ টাকা করে। ৫২ হাজার ৩৫৮ টাকা দরে টিভি কেবিনেট কিনে প্রতিটি ওঠানোর খরচ হয় ৬ হাজার ৮২১ টাকা। ৪০ হাজার ৮৯৩ টাকা দরে ডিভাইন ক্রয় করে প্রতিটি ওঠাতে ৫ হাজার ৩৯৬ টাকা করে ব্যয় দেখানো হয়। সব মিলে ২০ তলা ওই ভবনটির আসবাবপত্র ক্রয় ও ফ্ল্যাটে ওঠাতে বাবদ ব্যয় হয় ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা।
এ বিষয়ে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান বলেন, ‘আমরা গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিধিবিধান মেনেই কাজ করে থাকি। এখানে উন্মুক্ত দরপত্র দিয়ে মালামাল কেনাসহ অন্যান্য কাজ করা হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই। সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই করা হয়েছে।’
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো: শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেয়ার আগেই এসব কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাই খোঁজখবর না নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। যদি কোনো সমস্যা থাকে, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’
গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো: শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, ‘এ ধরনের একটি বিষয় আমাদের দৃষ্টিতে আসার পর দরদাম ও অন্যান্য বিষয়াদি দেখার জন্য কমিটি গঠন করে দিয়েছিলাম। এরপর তারা কী করেছে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’