একদিন মগজের পৃথিবী

মারুফ কামরুল

মগজের চারপাশে আঠারো সংখ্যাটির আনাগোনা। সতেরো পেরুনো মগজটি বাসে চড়েছে-  ঢাকার পথে। জানালার কাঁচে চোখ লেগে আছে। একটি সংখ্যালগু পিছুটান মগজকে কি যেনো শিখিয়ে দিয়েছিলো, সেটাই মিলেয়ে দেখছে।

পাঁচ বছর আগে মগজটা ফড়িং এর সঙ্গম ভেঙে আনন্দ পেতো। আরো মগজের সাথে মিলেমিশে তৈরি করতো মাছ মারার ফাঁদ। কলা পাতার সবুজে ঘর বাঁধতো। পরস্পরে রান্না করতো দল ভাঙা রূপালি পুঁটির ঝোল। ভাতের হাঁড়ি পূর্ণ হতো সেয়ানা চালে। এসব নিয়ে ভাবতে থাকা মগজগুলো জেন্ডার বুঝতো না। কিলটিল বুঝে নিতে পারলে জয়ী হওয়ার আনন্দে সমতল বুক চাপড়াতো।

মগজের বয়স বছর দুই বাড়তেই বরই ফুল ছেড়ার চিন্তা ঝরে যায়। দিনে দিনে ভাগ হয়ে যায় দুরন্ত মগজের দল। কেউ হয়ে যায় ছেলে মগজ, কেউ মেয়ে।

এ এক অদ্ভূত সময়। লুকোচুরি খেলে  প্রতিটি মগজ। গলা চিরে অট্টহাসি এলে মগজের শাসনে বিলীন হয়ে যায় গলা চাপা হাসিও। কেউ নিজেকে প্রকাশ করছে, কেউ লুকিয়ে রাখতে আরাম পাচ্ছে। গড়ে তুলছে নিজস্ব ইমারত। প্রতিটি মগজ নিজ অক্ষে ঘুরতে থাকে আরো দু’এক বছর।

এরপর তৈরি হয় নিজস্ব দৈহিক কাঠামো। ছেলে মগজ বুকের বোতাম আলগা করে দখিনা বাতাসের আঘাতে মেলে ধরে নিজেকে। মেয়ে মগজের জামার উপর বাড়তি পর্দা ঝুলে। ঠিক তখন ভালোবাসা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে। একেকটি নক্ষত্র ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। পুনরায় কাছে যেতে চায় দল থেকে চলে যাওয়া বিপরীত মগজকে। বাসের সিটে বসা আঠারো ছুঁই ছুঁই মগজটি বিপরীত মগজের কাছে যেতে চাওয়া গোল্লাছুট তাড়িত। তখন নাগরিক জানালায় ভেসে উঠে গোঁফের ক্রমাগত বেড়ে চলা।

ছুটতে হয় বিপরীত দিকে, যেখানে একজন মগজ বহুআগে গিয়েছিলো। গোল্লাছুটের বাদ পড়া মগজটি জানালার কাঁচে দেখছে নরম হাতের আহবান। তার পাশে বসা লোকটি মগজ ছেড়ে পুরুষ হয়ে গেছে বহু আগে। সে দেখছে কোমল হাতের আহবানে জানলার কাঁচে চেয়ে থাকা মগজের চোখে- শির বেয়ে উঠে আসা ভবিষ্যৎ। এই শহরের বাতাসে একদিন তার আঠারো বছর হবে। চোখ বুঁজে নানাবিধ সূত্রাদি ঠেসে মগজকে তামাটে করে তুলবে।

সেও খুঁটিনাটি বৃত্ত ভরাটে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। জায়গা করে নিবে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন কক্ষে-  টিউবে টিউবে সঞ্চারিত হবে মগজের নতুন সংযোজন। এবং এটা হতেই হবে। বছর পেরুতেই দেখা হয়ে যাবে কলা ভবনের তুখুর কবিতা পাগল মেয়ে মগজের সাথে। একদিন সবুজ মাঠে মুখোমুখি বসে বাদামের খোসা ছাড়াতে গিয়ে মগজ থেকে পুরুষ ও নারী হয়ে উঠবে- তারা। আঙুল থেকে ঠোঁটে গিয়ে ঠেকবে মানবিক কম্পন। এটাই তো প্রেম- মনে হতে থাকবে। বছরে বছরে পাতা উল্টে এক ঘরে থাকার অনুমতি পেয়ে যাবে, দুজনে।

শুরু হবে পূর্ববর্তী পুরুষের মতো জীবন যাপন। শাড়ীর আঁচল বড্ড এলোমেলো থেকে যেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে নারীর। সুগন্ধি উধাও হয়ে, সাংসারিক ঘামে ভিজবে ব্লাউজ। এরপর এক নিকটবর্তী দূরত্ব জায়গা করে নিবে পুরুষ-নারীর মধ্যখানে। দূরত্ব থেকে চুম্বকীয় সূত্রে উল্টোমুখি হবে গতদশকের প্রেমিক জুটি। বহদিনপর অঙ্গীয় আহবানে ক্ষণকালের জন্য দুজনে এক হয়ে যাবে- শামুকের মতো। ঘামের ঘনঘটা টের পেলে আলগা হয়ে যাবে- যেনো হতেই হবে। এভাবেই হয়ে আসছে।

এই পরিস্থিতি বহুদিন কেড়ে নিবে আয়ুকাল থেকে। এক বিছানায় বহুতল দ্বান্দিক পাহাড় এ সময়ে চেঁপে বসে- এদের ঘাড়েও বসবে। হঠাৎ এক ফজরে চুমু খেতে গিয়ে দেখবে চামড়া বঁটে গেছে। মগজ তখন দেহ দুটোকে টেনে আনবে কাছাকাছি- ওদের আরো একবার মিলনের প্রয়োজনে।

ওরা এক হয়ে যেতে চাইবে। অথচ- থেমে যাবে, পারবে না। সকালে টের পাবে ওরা আর নারী-পুরুষ নেই- বেখালি মগজ হয়ে গেছে। যবে মগজ ছেড়ে নারী-পুরুষ হলো, এই অবদি কতটা দিন, কতটা রাত নারী-পুরুষ হয়ে কাটিয়েছিলো, সে হিসেব কষতে বসবে। অথচ- মনে পড়বে কিছুই। এই মনে পড়া নাপড়ার জটিলতায় দাঁতের পাটিও আঁসটে গন্ধ ছড়াবে। অসহ্য মগজদ্বয় মুক্তির গান গাইতে চাইবে- গলা ছেড়ে। দেহ টুশব্দটিও করবে না।


কোনো এক মধ্যাহ্নভোজ অনুষ্ঠানে দেখা হবে তাদের ফড়িং ধরার সেই মগজগুলোর সাথে। শুধু ওদের নয়, আমাদের হয়তো এমন! উভয়ে মগজকে ছুটি দিবে ফড়িং এর সঙ্গম নষ্ট করা মগজগুলোর ডাকে।  দুজনের মগজ বেছে নিবে স্ব স্ব দল। ফড়িং পিছে ছুটতে ছুটতে ঘরে ফেরার কথা ভুলে যাবে। জেন্ডার ভুলে আবার হয়তো সমতল বুক মেলে দিবে দিগন্তে। একদিন পৃথিবী একটি স্বাধীন মগজের মতো কিলবিল করবে। মনে থাকবে না, এরা এক সময় নারী-পুরুষ কাটিয়েছে জীবন। কিংবা তাদেরও প্রেম ছিলো।

লেখক পরিচিতি:

মারুফ কামরুল, কবি ও গল্পকার। তিনি মূলত ছোটগল্প লেখেন। তার জন্ম ১৯৯৫ সালের ৭ নভেম্বর, কুমিল্লার মনোহরগঞ্জে।

বিভৎস সব চিন্তা-ভাবনার ভেতর দিয়ে একটি মনস্তাত্তিক ভ্রমণ তার ছোটগল্পে পরিলক্ষিত।যৌনতাকে তিনি নতুনমাত্রায় সংযোজন করেছেন তার গল্পে। সম্পাদনা করেন সাহিত্যের কাগজ ‘সমরেখা’।

অলংকরণ: মৌমিতা ভট্টাচার্য ও মীর রবি

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে