দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ পরস্পরকে দুষছে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, রাজধানীর সঙ্গে দেশের ২১টি জেলার যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় ঈদে ঘরেফেরা মানুষ দুর্ভোগের শিকার হতে পারেন।
কৃত্রিম ফেরি সংকট, টিকিট কাউন্টার ও গাড়ি সিরিয়ালের ক্ষেত্রে দালালচক্রের তৎপরতা এবং ভিআইপি নামে এসি বাস সিরিয়াল ছাড়াই পারাপার করায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণে দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। জনদুর্ভোগ বাড়ছে, জনঅসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসনের মতে, এমন অবস্থা চলতে থাকলে ঈদে যানজটের তীব্রতা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটের বর্তমান অবস্থা নিয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ পরস্পরকে দুষছে। ফেরি পার হওয়ার পরও যানজটে দৌলতদিয়া ঘাটে ডিসি-এডিসি প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে ছিলেন।
সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো এক চিঠিতে ঘাটের দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক। তবে এসব তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন।
তাদের মতে, বৈরী আবহাওয়া, ফেরি সংকট ও অবকাঠামোগত সমস্যা না থাকলে ঘাটে যানজটের সৃষ্টি হবে না। বর্তমানে ঘাটে খুব একটা সমস্যা নেই বলেও দাবি পুলিশের। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে ওই ঘাটে ঈদে যাত্রী ব্যবস্থাপনায় সাত ধরনের সমস্যা তুলে ধরে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন তা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে একাধিক পরিবহন কোম্পানির মালিক জানান, বর্তমানে পাটুরিয়া (মানিকগঞ্জ) ও দৌলতদিয়া (রাজবাড়ী) উভয়ঘাটে ফেরিতে উঠতে সাধারণত এক থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
সাপ্তাহিক বা সরকারি ছুটির আগের দিন ও রাতে যানজটের তীব্রতা বেশি থাকে। তারা জানান, ফেরিঘাটের উভয়পাড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) বাসগুলো অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। এজন্য বাড়তি টাকাও পরিশোধ করতে হয়। তারা জানান, ঢাকা-মাওয়া রুটে রাস্তা নির্মাণ কাজ চলায় ভারি ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস ওই রুটে যেতে চায় না। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুট তারা বেশি ব্যবহার করছে। এ কারণে এ ঘাটে গাড়ির চাপও বেশি।
ঈদের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্র জানায়, এবার পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে ২০টি ফেরি রাখা হচ্ছে। বর্তমানে সেখানে ১৭-১৮টি ফেরি রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের আরেক ফেরি রুট শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী রুটে ১৮টি ফেরি রাখা হবে। এ দুটিসহ পাঁচটি রুটে মোট ৫০টি ফেরি চালাবে সরকারি এ সংস্থা।
দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটে বিদ্যমান অনিয়ম প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছেন রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী।
ওই চিঠিতে বলা হয়, দৌলতদিয়ায় কৃত্রিম ফেরি সংকট এবং টিকিট কাউন্টার ও গাড়ির সিরিয়ালের ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ ও ডিবি পুলিশের সহযোগিতায় স্থানীয় দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। এ কারণে প্রায়ই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে এবং জনঅসন্তোষের সৃষ্টি হচ্ছে।
বিশেষ করে এসি বাসগুলোকে ভিআইপি হিসেবে আখ্যা দিয়ে পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। সেগুলোকে ফেরিতে তোলায় এবং দ্রুত বের হওয়ার পথ করে দেয়ায় যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
চিঠিতে বলা হয়, পুলিশ সুপার (আসমা সিদ্দিকা মিলি) যোগ দেয়ার পর ডিসি, বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির স্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে না। এককভাবে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। চিঠিতে নিজের দুর্ভোগের কথা উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক লিখেছেন, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩০ এপ্রিল ঢাকায় সভা হয়েছে।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদান শেষে ফেরার পথে রাজবাড়ীতে রাত ১২ থেকে ২টা পর্যন্ত ঘাটে আটকা পড়েছিলাম। ওই সময়ে ঘাটের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা পরিলক্ষিত হয়েছে।
৫ মে রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আলমগীর হুছাইন দাফতরিক কাজ শেষে ফেরার পথে রাতে দুই ঘণ্টা আটকা পড়েছিলেন। চিঠিতে জেলা সমন্বয় কমিটির সভায় অনুপস্থিত থাকলেও পুলিশ সুপার পৃথক দুটি আইনশৃঙ্খলা বৈঠক করেছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলমগীর হুছাইন ওই চিঠির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ঘাটে তার আটকে পড়ার বিষয়ে তিনি মত ও পথকে বলেন, প্রায় দুই ঘণ্টা আটকা পড়েছিলাম। এর কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফেরিতে গাড়ির ওঠার জন্য এক লেনে প্রবেশ ও ফেরি থেকে গাড়ি নামার জন্য এক লেনে বাহির হওয়ার পথ রয়েছে। অনেক সময়ে বাহির হওয়ার পথে গাড়ি ঢুকে যায়। এতে যানজট সৃষ্টি হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।
এদিকে জেলা প্রশাসকের চিঠিতে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি।
তিনি বলেন, দৌলতদিয়া ঘাটে আমাদের ব্যবস্থাপনা ভালো থাকার কারণেই প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি নির্বিঘ্নে পার হচ্ছে। গাড়ি বাহির হওয়ার পথ সবসময় ফাঁকা থাকে। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে সাময়িক সমস্যা হতে পারে। সেটাও পুলিশ সমাধান করছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ সদস্যরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন বলেই জনসাধারণ খুশিতে পার হচ্ছে। আসন্ন ঈদে বৈরী আবহাওয়া না থাকলে সব ফেরি সচল থাকলে এবং শিমুলতলী-কাঁঠালবাড়ী রুটে বড় গাড়ি পার করলে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে কোনো যানজট হবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে।
বাস মালিকসহ বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে আসমা সিদ্দিকা মিলি বলেন, ঈদ উপলক্ষে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও মেহেরপুরসহ বিভিন্ন জেলার লোকাল বাসও রাজবাড়ীতে আসে। যেহেতু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুলিশের ওপর, তাই সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এটা অন্যায় কিছু নয়।
দৌলতদিয়া ঘাটের সমস্যা
দৌলতদিয়া ঘাটের সাত সমস্যা তুলে ধরেছে জেলা পুলিশ। এতে অবকাঠামোগত সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দৌলতদিয়ায় ছয়টি ঘাট থাকলেও সচল চারটি।
২ নম্বর ঘাটে ফেরি ভেড়ে না এবং ৬ নম্বর ঘাটের কার্যক্রম বন্ধ। ৩ নম্বর ঘাটের সংযোগ সড়কটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও এবড়ো-খেবড়ো। এছাড়া দৌলতদিয়া পদ্মার মোড় থেকে ফেরি ঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার প্রবেশপথটি খানাখন্দ থাকায় সেখানে যানজট তৈরি হচ্ছে। তিনটি ট্রাক টার্মিনালের দুটির কিছু অংশে দোকানপাট ও স্থাপনা তৈরির সরঞ্জামাদি থাকায় পার্কিং সমস্যা হচ্ছে।
- আরও পড়ুন >> বুথফেরত জরিপে মোদিই থাকছেন প্রধানমন্ত্রী
অপ্রশস্ত জায়গায় ওয়ে স্কেল বসানোর কারণে যান চলাচলে বিঘ্ন ও যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া আলোর স্বল্পতাসহ কিছু সমস্যা তুলে ধরে যানজট নিরসনে এর সমাধান চেয়েছে পুলিশ।
ঈদ প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাজেদুর রহমান মত ও পথকে বলেন, ঈদ সামনে রেখে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দুই ঘাটেই সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ঘাট এলাকায় লাইটিং করা হচ্ছে। টয়লেট ও বিশ্রামাগার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে।
তিনি জানান, বর্তমানে দৌলতদিয়া প্রান্তে ছয়টি ফেরিঘাট রয়েছে আর পাটুরিয়া প্রান্তে রয়েছে চারটি। সব ক’টিতেই ফেরি ভিড়তে পারছে। পাটুরিয়ায় একটি ঘাট নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।