ক্রূর কাঠ-ফাটা রোদ্দুরে

মাসুদ খান

রসায়ন

কুমির যা-কিছু খায়, সেসবও কি পরিণত হয় কুমিরে?’
-জালালউদ্দিন রুমি

মন-মেদুর-করা সুর তুলত এক রাখাল।
বাঘে খেয়েছিল তাকে, বহুদিন আগে।
দিনে-দিনে সেই বাঘ কেমন উদাস, আনমনা, অহিংসপ্রায়
গোলপাতার আড়ালে আড়ালে…

দুর্ধর্ষ এক দস্যু– লুটেরা, নৃশংস, খুনি ও ধর্ষক।
খেয়েছিল তাকে এক বাচ্চা বাঘে, বহুকাল আগে।
বড় হয়ে সেই বাঘ এখন বনের সবচেয়ে আগ্রাসী, সবচেয়ে হিংস্র শিকারি।

তারপর একদিন
উড়ন্তপ্রায় হরিণের হলকুম কামড়ে ধরার ঠিক আগের মুহূর্তে
দপ করে নিভে যাবে দাউদাউ নৃশংস হৃদয়,
শূন্যের মধ্যেই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে-ওঠা উন্মত্ত বাঘের।

পরমা কথা বলে ওঠে প্রকৃতির ভাষায়

তোমাকেই নিগড়িত করবার সমস্ত কৌশল
ভানুমতি ভোজবাজি সব রপ্ত করেছে মানুষ।
আর মেয়ে, নিগড়কে তুমিও নূপুর ভেবে
মাঝে মাঝে পরে ফেলছ পায়ে।

বলো মেয়ে, মন খুলে আজ বলে যাও সব,
চুপচাপ শুনে যাব, প্রতিবাক্য করব না কোনো।
আমি কথা বলব মুদ্রণপ্রমাদে-ভরা খরখরে গদ্য-জবানে
প্রত্যুত্তরে তুমি বলে যাবে অনর্গল
বরফ-গলানো এক পরিস্রুত প্রকৃতি-ভাষায়,
সরলসার, সুললিত চারুপদ্যে–

নারীরূপে আসতে যদি ভবে
বুঝতে তুমি দুঃখজ্বালা তবে।
বলতে পারো কোথায় তোমার থেকে
পিছিয়ে ছিলাম কখন এবং কবে?
হাজার বছর ধরে
জঞ্জাল সাফ করে
গড়েছি এই মানবসমাজ তবে।
দিনে দিনে করেছ তা জটাজটিল কাঁটাবহুল আগাছা-সংকুল
তাই তো দিতে হচ্ছে এখন নিত্যনতুন ভুলের মাশুল আরো অধিক ভুল।

উজিয়ে এলাম হাজার বাধা, হাজার দমন দলন
আবার বাধা, আবার দমন, আবার পদস্খলন
এমন করেই এগিয়ে গেছি, আজও আগুয়ান
ধারণ-সহন-প্রাণশক্তি প্রকৃতির সমান।
প্রকৃতি যা, এক অর্থে পরমা-ও তো তা-ই
বিভেদ ছেড়ে এই আমরাই অভেদটা শেখাই।

পরমাকুল আমর্মমূল নিজেই তো প্রকৃতি।
প্রকৃতিকেই শেখাচ্ছ আজ স্বভাব, সংস্কৃতি?
দায়িত্বজ্ঞান, রীতিনীতি, প্রেম, প্রজ্ঞা, প্রীতি?

প্রাণকে ফোটাই। স্তন্য দিয়ে, অন্ন দিয়ে করি বিকশিত
তাপ ছায়া আর মায়া মেখে, জীবন ঘষে করি উজ্জীবিত।
একাধারে প্রজায়িনী, প্রাণপালিনী, এবং প্রশিক্ষক
অন্নদা ও স্তন্যদায়ী, প্রাণশক্তি-আয়ুর উদ্বোধক।
স্নেহশাসন, প্রীতিবাঁধন, পালনপোষণ… সবই অবিরত
সাধন করি। সর্বোপরি পালন করি ব্যবস্থাপন-ব্রত।

কালে কালে ঘোর সংকট ঘুরে-ফিরে আসে
আজ ফের সেই দুঃসংকেত ভঙ্গুর সমাজে।
মর্দানি-ভাব দমিয়ে রেখে জাগাও নারীভাব
ভেতর-বাহির বোধন ঘটাও প্রকৃতি-স্বভাব।


জেনে রেখো, চিড়-ধরা এই সমাজ-সারাই কাজে
হন্যে হয়ে ফিরবে শেষে নারীভাবের কাছে।”

এ-নিস্তারহীন ক্রূর কাঠ-ফাটা কঠোর রোদ্দুরে
এক মহাচ্ছায় গাছের গোড়ায় ঠেস দিয়ে
কিছুটা থতোমতো খেয়ে, হতভম্ব হয়ে
চুপচাপ অনুভব করে যাব প্রকৃতির এই কণ্ঠ,

এই পরিস্রুত ভাষার আগুন।

ভাবাধিনায়ক

তোমার উৎফুল্ল হরতনের রাগরক্তিম ব্যঞ্জনা এসে লাগে
আমার সাজানো তাসে। কী ভাব জাগালে ওহে ভাবাধিনায়ক,
আকাশে বাতাসে আর আমাদের প্রথাসিদ্ধ তাসের সংসারে!
ফুটে ওঠে লজ্জারং, জেগে ওঠে রংধনুরূপ, ব্যাকুল তাসের সেটে।

হে ভাবের কম্যান্ডার, বোঝা ভার এ হরতনি লীলাটি তোমার।

লজ্জা-প্রভা-ফুটে-ওঠা স্পন্দমান তাসকেই করেছ হে তুরুপের তাস– অব্যর্থ, মোক্ষম।
পুনরায় টেক্কা মেরে দিয়েছ ঘায়েল করে সব উপশম, একদম।

লেখক পরিচিতি:

মাসুদ খান, কবি, লেখক ও অনুবাদক। জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, পিতার কর্মস্থল জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ।

স্বাধীন বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যে অধুনিক কবিতায় নতুন কাব্যতত্ত্বের জন্য তার নাম প্রথমেই উচ্চারিত হয়। বলা হয়ে থাকে- বাংলা কবিতার বাঁক বদলের ইতিহাসে যে ক’জন কবির নাম উচ্চারণ করা হবে, তাদের মাঝে তিনিও একজন। তার প্রকাশিত বই প্রায় দশের অধিক।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল, সব্যসাচী মিস্ত্রি ও মীর রবি

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে