আওয়ামী লীগের দুই নেতাসহ ১৬ জনকে আসামি করে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র প্রস্তুত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ মামলায় গ্রেপ্তার ২১ জনের মধ্যে তদন্তে ৫ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। অভিযোগপত্রটি এ মাসের মধ্যে আদালতে জমা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে তদন্ত সংস্থাটি। মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পিবিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে।
পিবিআইয়ের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার গতকাল বলেন, মামলার তদন্তভার পাওয়ার পর ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপনের কাজ চলছে।
গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শরীরের ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পাঁচ দিন লড়ার পর মারা যান তিনি। মৃত্যুর আগে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার একটি বর্ণনা দিয়ে যান নুসরাত। আগুন ধরানোর আগমুহূর্তে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগে করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছিলেন।
নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ৮ এপ্রিল সোনাগাজী থানায় মামলা করেন তার ভাই মাহমুদুল হাসান। এরপর স্থানীয় থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠলে মামলার তদন্তভার পায় পিবিআই।
ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই জানায়, নুসরাত খুনিদের লক্ষ্য হন গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনার পর থেকেই। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। এরপর থেকেই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল পরিবারটিকে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, মামলার তদন্তভার পাওয়ার আগেই সোনাগাজী থানার পুলিশ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন মো. আফসার উদ্দিন, মো কেফায়েত উল্যাহ, মো. আরিফুল ইসলাম, মো. আলা উদ্দিন, মো. নূর হোসেন ওরফে হোনা মিয়া, মো. সাইদুল ইসলাম ও উম্মে সুলতানা পপি। তাদের মধ্যে ঘটনার সঙ্গে কেবল মাদ্রাসাশিক্ষক আফসার উদ্দিন ও মাদ্রাসার ছাত্রী উম্মে সুলতানা পপির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
গত ২৪ এপ্রিল আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মাদ্রাসাশিক্ষক এস এম সিরাজ উদদৌলা নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। অধ্যক্ষ তার জবানবন্দিতে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন ও সোনাগাজী পৌরসভা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলমের কথাও উল্লেখ করেছেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদন্তে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া ১৬ জনের মধ্যে অধ্যক্ষ ছাড়াও সাতজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই আটজনের জবানবন্দিতে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় উম্মে সুলতানা, কামরুন নাহার, শাহাদাত হোসেন, জাবেদ হোসেন ও সাইফুর রহমান মো. জুবায়েরের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এই পাঁচজন মিলে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদদৌলাকে তারা হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে দেখছেন। আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও মাকসুদ আলম ঘটনার অর্থায়ন এবং আশ্রয়দাতার কাজ করেছেন। গ্রেপ্তার বাকি আটজন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন।
এদিকে নুসরাত হত্যার ঘটনা তদন্তে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে জেলা সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলমকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ছাড়া সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, এসআই (নিরস্ত্র) মো. ইউসুফ এবং এসআই (নিরস্ত্র) মো. ইকবাল আহাম্মদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রতিবেদনে ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পি কে এম এনামুল করিমের বিরুদ্ধেও অভিযোগ করা হয়।