ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৮টায়। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে আলোচনা, কারচুপির আশঙ্কা-উদ্বেগ এবং বিরোধীদের নানা আরজি, উত্তেজনা ও ইভিএম পাহারার মধ্য দিয়েই আজ বৃহস্পতিবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়।
সকাল ৮টায় নির্ধারিত গণনাকেন্দ্রগুলোতে দেশজুড়ে শুরু হয় ইভিএমের ভোটগণনা। তবে যান্ত্রিক গণনায় জটিল ভেরিফিকেশন (পুনর্যাচাই) পদ্ধতির কারণে ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব হতে পারে। স্বাভাবিকভাবে বিকেল ৪টার মধ্যে ফলাফল প্রকাশের কথা। কিন্তু কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, ইভিএমের সঙ্গে ভোটার স্লিপ তথা ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রায়াল (ভিভিপ্যাট) যাচাই করতে গিয়ে ফলাফল ঘোষণায় রাত ১০টা লেগে যেতে পারে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, ইভিএম ও ভিভিপ্যাটের নম্বর মেলানোর প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ার কারণে ফলাফল প্রকাশে ৩০ ঘণ্টা বিলম্বও হতে পারে। মূলত ইভিএম কারচুপির আশঙ্কা ওঠায় প্রার্থীদের বারবার গণনার দাবি উঠলে এবারের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় অনেক বিলম্ব ঘটতে পারে।
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক নির্বাচনটি করতে সময় নিয়েছে ছয় সপ্তাহ তথা প্রায় দেড় মাস। সাত দফায় গত রবিবার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিশ্বের সর্বোচ্চসংখ্যক ব্যালট গণনা করতে হচ্ছে এক দিনেই। নির্বাচনে ৯০ কোটি ভোটারের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বেশি পড়েছে বলে জানা গেছে।
উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, নালিশ : ভোটগণনা যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকার পরও বিরোধী দলগুলোর উদ্বেগের শেষ নেই। এ জন্য গত মঙ্গলবার ২২টি বিরোধী দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ইভিএমের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। তারা ভোটগণনার সময় ইভিএমের সঙ্গে শতভাগ ভিভিপ্যাট যাচাইয়ের দাবি করেছে, যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আছে প্রতি আসনের পাঁচটি কেন্দ্রের ভোট ইভিএম ও ভিভিপ্যাটের সঙ্গে মেলাতে হবে। কিন্তু বিরোধীদের দাবি গতকাল বুধবার প্রত্যাখ্যান করেছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধীদের এই দাবির ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ক্ষমতাসীন বিজেপি।
মূলত গত রোববার ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর বুথফেরত জরিপে বিজেপির ফের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিরোধীরা ইভিএম নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে অনেক স্থানে ইভিএম রাখার স্থান স্ট্রংরুমগুলোর সামনে পাহারা বসিয়েছে অনেক প্রার্থীর লোকজন। স্বয়ং কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সমর্থকদের স্ট্রংরুম পাহারা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের স্ট্রংরুম পাহারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিজেপি।
ইভিএমের নিরাপত্তা : ১১ এপ্রিল থেকে প্রতিটি ধাপেই ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর তিন স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে বিভিন্ন রাজ্যের স্ট্রংরুমগুলোতে (সুরক্ষিত ঘর) রাখা হয় ইভিএম। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোও সেগুলো নজরদারি করতে পারে। তিন স্তর নিরাপত্তার প্রথম স্তরটি ছিল ভবনের ভেতরে, স্ট্রংরুমের দরজার তালাবদ্ধ দরজার বাইরে। এর বাইরে আরেকটি দল ছিল, যারা পুরো ঘরটির নিরাপত্তা দেয়। তাদের সশস্ত্র পাহারার পাশাপাশি মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতে হয়। এই স্তরে ছিল সিসিটিভির নজরদারিও। আর তৃতীয় স্তরটি হচ্ছে ভবনগুলোর সীমানাদেয়াল বা ফটকে। সশস্ত্র রাজ্য পুলিশের কর্মীরা সেখানে গণনার আগের দিন পর্যন্ত কাউকেই ঢুকতে দেয় না। তবে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিয়ে সব প্রার্থীর প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বিশেষ প্রয়োজনে সেখানে রিটার্নিং অফিসার ঢুকতে পারেন। আর স্ট্রংরুমগুলোর বাইরেই রাখা হয় ভোট গণনা কেন্দ্র।
ভোট গণনা প্রক্রিয়া : সশস্ত্র পুলিশ থাকে স্ট্রংরুমগুলোর বাইরে। তারা নিশ্চিত করে নির্বাচনের আগে কোনোভাবেই কেউ ইভিএম স্পর্শ করতে না পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রতিনিধিরা চাইলে এই স্ট্রংরুম ২৪ ঘণ্টার পাহারায় যোগ দিতে পারে অথবা ২৪ ঘণ্টাই তারা সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি প্রচারিত দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এরপর মেশিনগুলো যখন স্ট্রংরুম থেকে গণনাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে প্রতিটি স্তরেই রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকতে পারেন এবং মেশিন যাচাই করে দেখতে পারবেন। এমনকি গণনার জন্য মেশিন টেবিলে রাখার পরও। মেশিন টেবিলে রাখার পর নীল রঙের কলম ও ছুরি দিয়ে মেশিনের সিল ভাঙতে হবে।
ভারতের ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার সন্দ্বীপ জাইন বলেন, মেশিনগুলো টেবিলে রাখার পর সব পক্ষের আপত্তি না থাকলে একজন কর্মকর্তা বাটনে চাপ দেবেন। এতে একজন করে প্রার্থীর ইলেকট্রনিক ব্যালটের হিসাব বের হয়ে আসবে। একেক দফায় প্রতি ২০ থেকে ২৫ মিনিটে ভোট গণনা করা হবে এবং নম্বর তালিকা (টেবুলেশন শিট) তৈরি করা হবে। এভাবে দফায় দফায় ভোটগণনা চলবে এবং ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তবে সব প্রার্থী, তাদের প্রতিনিধিবর্গ ও নির্বাচনী প্রতিনিধিরা (ইলেকটোরাল ডেলিগেট) যদি এই ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত গণনার কাজ সমাপ্ত করা হবে না।
জাইন বলেন, এই প্রক্রিয়ায় দেশব্যাপী ভোটগণনায় প্রায় আট ঘণ্টা সময় লাগবে। সে হিসাবে বিকেল ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ফলাফল ঘোষণা করার কথা।
কাগজের প্রমাণ : এবারের নির্বাচন থেকেই ভারত ইলেকট্রনিক মেশিনে ভোট নেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেক ভোটারের বিপরীতে একটি কাগুজে প্রমাণ রাখার ব্যবস্থাও করেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ভিভিপ্যাট বা কাগজের স্লিপ। ভোটার ইভিএম বাটন চেপে ভোট দেওয়ার পর তার সামনেই পাশের প্রিন্টারে তিনি যে প্রতীকে ভোট দিয়েছেন, তা ছাপা হয়ে বের হবে এবং তা আলাদা একটি বাক্সে পড়বে। এই স্লিপও সংরক্ষণ করে রাখে কমিশন।
গত ১১ এপ্রিল নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশনায় বলেছেন, ভোটগণনার সময় প্রতিটি আসনের বিপরীতে দৈবচয়নের ভিত্তিতে পাঁচ ভোটকেন্দ্রের ভিভিপ্যাটের সঙ্গে ইভিএমের ভোটের হিসাব মিলিয়ে দেখতে হবে। সে হিসাবে ১৩ লাখ ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ২০ হাজার ৬০০টি কেন্দ্রের ভিভিপ্যাট মেলাতে হবে আজকের ভোটগণনায়।
তবে ইভিএমে ভোটগণনার আগে গণনা করা হবে পোস্টাল ব্যালটের ভোট। ভারতের আইনে ডাকযোগে দেওয়া ভোটও কঠোর নিরাপত্তায় রাখা হয়। পোস্টাল ব্যালট গণনার ৩০ মিনিট পর শুরু হবে ইভিএমের ভোটগণনা।
যে কারণে ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হবে : নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার উমেশ মিশ্র বিবিসিকে জানান, ইভিএমের ভোটগণনার পরে ভিভিপ্যাট যন্ত্রের কাগজের স্লিপ গোনা শুরু হবে। এর পরে দু’টি যন্ত্রের ভোটের সংখ্যা মিলিয়ে দেখা হবে। আসনপ্রতি পাঁচটি করে ভোটকেন্দ্রের ইভিএম আর ভিভিপ্যাটের ফলাফল মেলানো হবে।
ভোট নেওয়ার জন্য বৈদ্যুতিক ভোট যন্ত্র বা ইভিএম ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে গণনার দিন দুপুরের মধ্যেই মোটামুটিভাবে স্পষ্ট হয়ে যায় ফলাফল। কিন্তু এবারের ভোটে সব কেন্দ্রেই ইভিএমের সঙ্গে যুক্ত যে ভিভিপ্যাট যন্ত্র বা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা একটি একটি করে গুনতে হবে। ইভিএমের ভোটের সঙ্গে ভিভিপ্যাট যন্ত্রের ফলাফল না মিললে আবারও গুনতে হবে ভোট। এর পরই ফল প্রকাশ করা যাবে। একেকটি ভিভিপ্যাট যন্ত্রের ভোট গুনতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগবে।