রাজনীতিহীনতায় সমাধান নেই

খালিদ মারুফ

মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশকে একটি বিরাজনৈতিক ধারায় প্রবাহিত করার চেষ্টা বা ষড়যন্ত্র সহজেই চোখে পড়ে। দীর্ঘ সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের মোড়কে ধর্মান্ধ পাকিস্তান চক্রের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া, এবং পুনরায় গণতন্ত্রপুনরুদ্ধারের আন্দোলন-সংগ্রাম পেরিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাশ্চাত্য ও এনজিও প্রভাবিত সুশীল সমাজের অনুপ্রবেশ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই রাজনীতিহীনদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের ফল যে সুখদায়ী হয় না সেটাও স্পষ্ট হয়েছে।

অতিসম্প্রতি বিশেষত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘আই হেট পলিটিক্স জেনারেশন’ বলে যুবসম্প্রদায়ের একটা অংশকে চিহ্নিত করছি বিষয়টি দুঃখজনক যুগপৎ হতাশার। এই ধরনের রাজনীতিবিমুখ যুবসম্প্রদায় কেন এবং কীভাবে তৈরি হলো সেটি অবশ্যই খতিয়ে দেখা দরকার। সেনানিয়ন্ত্রিত দুই বছরের ‘সুশীল শাসনের’ শেষ দিকে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে ‘না’ ভোট নামক একটি নতুন ঘর ব্যালট পেপারে সংযুক্ত করা হয়। এটা সুস্পষ্ট যে, এই ‘না’টি ছিল রাজনীতির প্রতি ‘না’। প্রশ্ন হলো রাজনীতিহীন বাস্তবতায় রাষ্ট্রকে নিরাপত্তা দেবে কে? প্রতিষ্ঠানসমূহ, খনিজসম্পদ তথা জনগণের জান-মালের নিরাপত্তায় কাজ করবে কারা? প্রশ্ন করা দরকার যে, কাদের স্বার্থ রক্ষায় আমরা আমাদের সমাজকে নিরাজনৈতিক হতে দেব?

universel cardiac hospital

বাংলাদেশে এই নিরাজনীতিকতা চর্চার সূচনা হয় মূলত ১৯৭৫ সালের পর, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী সামরিক একনায়কদের কালে। নিরাজনীতিকরণ প্রজেক্টের আওতায় প্রথমেই আক্রমণ পরিচালনা করা হয় ছাত্র-রাজনীতির উপর। প্রচার চালানো হয় ছাত্র-রাজনীতি খারাপ, ক্ষেত্রবিশেষ প্রাণসংহারী এবং অবশ্যম্ভাবীরূপে ভবিষ্যদধ্বংসী। এবং এই ‘খারাপের’ অজুহাত হিসেবে ‘খাড়া’ করা হয় ছাত্র রাজনীতির সংঘাতময় বাস্তবতাকে। কেন এই সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হলো, সে বিষয়ে কোনো কথা না বলে, একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘ছাত্র রাজনীতিমুক্ত’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কলেজ বিদ্যালয়গুলো ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই সাইনবোর্ড আগ্রাসন চালায়। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রয়াত্ব প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতিমুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়। তারপর প্রতিষ্ঠিত হয় একের পর এক রাজনীতিমুক্ত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়।

নব্বই দশকের শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায় ডাকসু। বন্ধ হতে থাকে অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজসমূহের ছাত্রসংসদ। এই পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি সরল ও সাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। এবং এর কারণ হিসেবে হানাহানির বাস্তবতাকেও ‘একমাত্র’ হিসেবে দেখবার অবকাশ নেই।

আমরা অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রতিবাদি কর্মীটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়বার সাথে-সাথে ভেতরে থাকা প্রতিবাদের আগুনে ছাঁইচাপা দিয়ে নয়টা-পাঁচটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। অতএব কায়েমি স্বার্থবাদি গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য সাধনের পথে একমাত্র বাধা হয়ে থেকে যায় সচেতন ছাত্রসমাজ, একথা সর্বযুগে এবং পৃথিবীর সর্বপ্রান্তের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল বহুজাতিক সংস্থাসমূহ, যাদের বাণিজ্যের প্রধান ক্ষেত্র এদেশের খনিজ সম্পদ, ক্রিয়াশীল দাতাগোষ্ঠী, ঋণদানকারী বিশ্বসংস্থাগুলো, ধনিক রাষ্ট্রসমূহের উদ্বৃত্ত কর্পোরেট পুঁজির লোকদেখানো গরীবোন্নয়নের অভ্যন্তরে লুক্কায়িত ফাঁকি আবিষ্কার, এগুলোর পশ্চাতে থাকা চুক্তিসমূহ পুনর্মুল্যায়নের দাবি তুলবার সক্ষমতা রয়েছে একমাত্র রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত ছাত্র সমাজের। সুতরাং সংঘাতের দুয়ো তুলে ছাত্রসমাজকে বিরাজনৈতিক করার কাজটি তখনই শুরু হয়ে দারুণ গতিতে এগিয়ে চলে এবং এখনো সেটা চলমান। এই প্রক্রিয়ায় প্রচার মাধ্যম থেকে শুরু করে সম্ভব সবগুলো যন্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে, হচ্ছে। অভিভাবকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বিরাজনৈতিক বাণী, অপত্য স্নেহের বসে রাজনীতিমুখী সন্তানের দরজায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন স্বয়ং পিতা-মাতা।

ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি আবাসিক হলে ভিপি-জিএস হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ছয়জন অরাজনৈতিক প্রার্থী। বেশকিছু আমলযোগ্য অভিযোগসহ ডাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন একজন আপাত অরাজনৈতিক ছাত্র-প্রতিনিধি। ছাত্রলীগ বাদে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রদল এমনতর ছাত্রসংগঠনসমূহ ক্রিয়াশীল থাকা সত্ত্বেও একজন সাংবাদিক-ছাত্র ভিপি পদে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছেন। জিএস পদে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ এমনকি দ্বিতীয় সর্ব্বোচ ভোট পেয়েছেন অরণী সেমন্তী খান। তিনিও নিজেকে অরাজনৈতিক ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন।

ছাত্ররাজনীতির সংঘাতময় পরিস্থিতির কথা বলে তৈরি হওয়া অরাজনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে ধর্মশ্রয়ী গুপ্তরাজনীতির চর্চা যে চলেছে, এবং এখনো চলছে সে বিষয়টি বোধহয় সংশয়হীনভাবেই বলা চলে। কেননা হলিআর্টিজান কাণ্ড এবং সেই মানবতা বিধ্বংসী কাণ্ডে জড়িতদের কেউই ‘স্বভাবতই সংঘাতপ্রিয়’ ছাত্রসংগঠন বা ছাত্ররাজনীতির আওতাভুক্ত নন। সুতরাং যুবসমাজের জন্য একটি আদর্শ নির্ধারণ ও এর চর্চা অনিবার্য। সেই আদর্শের স্বরুপ কী হবে তা মুক্তিযুদ্ধের কারণ বিশ্লেষণের ভেতর দিয়েই নির্মাণ করা সম্ভব, এমনকি এ কাজ বেশ খানিকটা করাই আছে, প্রয়োজন কেবল চর্চাটুকু এবং সম্ভব এই চর্চার ভেতর থেকেই বাকিটুকু তৈরি করে নেওয়া।

দীর্ঘ সামরিক শাসন, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মাশ্রয়ী পাকিস্তানবাদী চক্রের বাড়-বাড়ন্ত, দাতাগোষ্ঠী-এনজিও চক্রের বিরাজনীতিকরণের পক্ষে সম্ভব সকল কার্যক্রম পরিচালনার ভেতর দিয়ে তৈরি রাজনীতিবিমুখিনতা দেশ জাতি সমাজ বা মানব সমাজের জন্য কী উপকার বয়ে আনতে সক্ষম? একটি আদর্শহীন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ-ই বা কী? যে সাম্য মানবতা ও গণতন্ত্রের আদর্শ পৃথিবীবাসীকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল, মুক্ত করেছিল, আজ সে আদর্শ বহুলাংশে থিতিয়ে পড়েছে। মানবতার মুক্তির অঙ্গীকার নিয়ে ঘোষিত কমিউনিস্ট আদর্শ খোদ কম্যুনিস্ট বলে পরিচয়দানকারীরাও এখন আর ধারণ করেন না।

সংস্কৃতির ভেতর দিয়েই মূলত একটি জাতি তার স্বরুপ প্রকাশ করে থাকে। স্বাধীনতা অর্জনের অববহিত পরেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছিলেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা তথা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের। গত এক দশকে সেই মুক্তির পথে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে গেছে; একথা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বাণিজ্যিক পরাশক্তিরগুলোর বিশেষ আগ্রহের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব এখনই সময় সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা তথা বাঙালি সংস্কৃতির সুস্পষ্ট রূপ নির্মাণের কাজটি এগিয়ে নেওয়া। আর এক্ষেত্রে পথ দেখাবে আদর্শভিত্তিক রাজনীতি, যা হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অধিষ্ঠান, অনুষদ কোনো কিছুই-এর আওতার বাইরে নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতা ও নিয়ন্ত্রনাধীন হয়েও আইবিএ একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এখানে অধ্যয়নরত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলধারার সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সাথে একেবারেই অপরিচিত। এই অপরিচয় থেকে আইবিএকে উদ্ধার করতে হবে, সে কাজ অতিঅবশ্যই ডাকসুর।

অমর্ত সেন তাঁর দীর্ঘ গবেষণায় দেখিয়েছেন অপরিচয়ই হিংসা সৃষ্টির প্রধান কারণ। কী লাভ হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজনীতিমুক্ত রেখে? কতজন নিব্রাস তৈরি করলো এইসব রাজনীতিমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? এই খতিয়ান বোধকরি রাষ্ট্রের পক্ষেও বের করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। আদর্শভিত্তিক রাজনীতির অনুপস্থিতিতে কী হয়? মানুষের সামনে বিকল্প রাজনৈতিক মতাদর্শ না থাকলে সে ক্রমশ মানবগুণ হারাতে থাকে, আশ্রয় খোঁজে ধর্মে, সেখান থেকে ধর্মান্ধতায় এবং অপর ধর্মাবলম্বী কিংবা দেখতে তার মতো নয় এমন মানুষকে অপরিচয়সূত্রে শত্রু জ্ঞান করে। এবং তা থেকে কোন মাত্রার মানবতাবিরোধী অপকর্মসমূহ ঘটতে পারে, পৃথিবীকে কীভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করতে পারে সে হিংসার আগুন তা আমরা উন্নত ও অনুন্নত পৃথিবীর কোণায়-কোণায় সংগঠিত দানবীয় হিংস্রতা থেকে জানতে-বুঝতে সক্ষম হচ্ছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এদেশের শিক্ষা, শিক্ষা প্রসাশন ও-এর সামগ্রিক চারিত্র নির্মাণে ভূমিকা পালনকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান। আর ডাকসু এর প্রাণ। ছাত্র-রাজনীতি কেবল ছাত্র অধিকার বিষয়ে কথা বলবে না-কি সামগ্রিক জাতীয় রাজনীতি-কৌশল ইত্যাদি নির্মাণে ভূমিকা পালন করবে? এই বিতর্ক পূর্বে হয়েছে এবং কেবল প্রথমোক্ত ভূমিকায় ছাত্ররাজনীতি সীমাবদ্ধ থাকবে না, থাকতে পারে না; সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। দীর্ঘ তিন দশকের অচলাবস্থা কাটিয়ে পুনরায় চালু হওয়া ডাকসু যেন কিছুতেই মানুষের হতাশার কারণ না হয়। সদ্য চালু হওয়া ডাকসুর কেন্দ্রীয় ও হল সংসদে নির্বাচিত ছাত্রপ্রতিনিধিবৃন্দকে শুভেচ্ছা জানাই। আন্দোলন যার অসুখে পরিণত হয়েছে, সে আন্দোলন করবে, ডাকসু করবে চর্চা-অনুশীলন আর থাকবে সজাগ। অর্জিত সাফল্যসমূহের সুরক্ষা দেবে, অভিষ্টে পৌঁছবার পথ বাতলাবে। আদর্শিক সমাজ নির্মাণে পালন করবে প্রধান ভূমিকা।

খালিদ মারুফ: কথাসাহিত্যিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে