সুঁইসুতা-কাজ জপে জপে

মুজিব ইরম

মানুষ

আমার শৈশব রাঙ্গা ছিলো পূজা পার্বণ ঈদে, আমার শৈশব গীতল ছিলো বাউল গান আর গীতে। আমার শৈশব শীতল ছিলো কাদা জলে পানিতে, আমার শৈশব ভরা ছিলো জিকির দরুদ কীর্তনে। উলুধ্বনি শাখের ধ্বনি ঘণ্টা আজান মাতমে, আমার শৈশব ভরা ছিলো সালাম আদাব প্রণামে। মাসি পিসি মায়ে বোনে মন্ত্র দোয়া পড়ে, আমার শৈশব রাঙ্গিয়ে দিলেন মানবতার বরে। আমার শৈশব কাটলো ঘুরে গির্জা মন্দির মসজিদে, বাউল গজল পীরমুর্শিদি ভজন সাধন কীর্তনে।

সেই যে আমার হুরুবেলায় দোতারা এক বাজিয়ে, কোন এক বাউল নৃত্যগানে মন দিলা যে সাজিয়ে! মানুষ ভজো মানুষ ভজো বাউল কবি কৈলা, তাই তো ইরম মানুষ খুঁজে পদের অধীন হৈলা।

রেশমি সুতার কাজ

মা যেমন নকশি কাঁথা শীতল পাটি বোনে, হাতের পাখায় ফুলপাখিগাছ তোলে, নকশা করা শীতের পিঠা বানায়, জরি পুতি রেশমি সুতায় রঙ্গিন ময়ূর আঁকে, মনের কথা লিখে, তেমনি করে বইয়ের পাতায় লেখার খাতায় তোমার জন্য রঙ্গিন কিছু ফুলপাখি আর প্রজাপতি আঁকতে চেয়েছি।

আর কিছু নয়, এই তো খায়েস মনে, যেমন করে মায়ের হাতের কাজগুলো বসার ঘরে শোভা হয়ে থাকে, যেমন করে দেয়াল জুড়ে মায়ের কথা বলে, তেমন করে তুমি তাকে টাঙ্গিয়ে রেখো মনে, গহিন সঙ্গোপনে।

এই ভাবেই সুঁইসুতা-কাজ জপে জপে হয় যেন গো ইতি: ফুল ফুটে ঝরে যায় এই তার রীতি, মানুষ মরিয়া যায় রেখে যায় স্মৃতি।

ভুলো না আমায়

এত করে লিখি আমি হয় না তবু শেষ, পানা ফুলে মন মজেছে জারুল ফুলে বেশ। হিজল ফুলের লতার মতো লটকে থাকে মন, বাউল গানের সুরের মতো কান্দে তবু তন। দূরের গাঁয়ে কুয়াশা নামে শাইল ধানের মাঠে, ঝুমকো লতা লটকে থাকে পুবের পুকুর ঘাটে। ধানের গন্ধে ঘুম আসে না বৃষ্টি পড়া শব্দে, যতই বলি ওরে ও মন এসব এবার বাদ দে। তবু ওরা লিখতে বলে হয় না লেখা শেষ, আছি আমি দূরের দেশে ওরাই আমার খেশ। ওরাই আমায় কুশল যাচে জিগায় নামধাম, মগডালে ওই লটকে থাকা সূর্যরঙ্গা আম। 

জানি আমি এমনই হয় বাড়িছাড়া হলে, দিবানিশি এসব এসে লিখতে শুধু বলে। আমি যেন ওদের কথা ওদের নিয়ে লিখি, শব্দবাক্যে তালের পিঠা রাঁধতে যেন শিখি। যেমন করে মায়ের হাতে ফুটতো কচু ফুল, লিখতে যেন ওদের কথা হয় না কভু ভুল। একটা ময়ূর তাইতো আঁকি শব্দবাক্য দিয়ে, যাবে উড়ে মায়ের দেশে আমার কুশল নিয়ে।

যেমন করে মায়ের রুমাল সবার আদর পায়, তেমন করে রাইখো মনে ভুলো না আমায়।

লেখক পরিচিতি:

মুজিব ইরম-এর জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার নালিহুরী গ্রামে। পারিবারিক সূত্র মতে ১৯৬৯, সনদপত্রে ১৯৭১। পড়াশোনা করেছেন সিলেট, ঢাকা ও যুক্তরাজ্যে। বাংলা সাহিত্যে তিনি এই সময়ের আলোচিত একজন কবি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ বিশের অধিক।

তিনি মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প পুরস্কার ১৯৯৬। বাংলা কবিতায় সার্বিক অবদানের জন্য পেয়েছেন সংহতি সাহিত্য পদক ২০০৯, কবি দিলওয়ার সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪ কবিবংশ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪শ্রীহট্টকীর্তন কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জয় বাংলার জন্য পেয়েছেন এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৭। এছাড়া পেয়েছেন বাংলা একাডেমি থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার ২০১৭।

অলংকরণ: মৌমিতা ভট্টাচার্য ও মীর রবি

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে