বড় তারকা হয়েও বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত যারা

ক্রীড়া প্রতিবেদক

বিশ্বকাপ
ফাইল ছবি

ইয়োহান ক্রুইফ, লিওনেল মেসি, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, পাওলো মালদিনি, মিশেল প্লাতিনি, অলিভার কান।এরা ছিলেন বলেই ফুটবল খেলাটা এত সুন্দর, এত সমৃদ্ধ। এই নামগুলোর কল্যাণেই ফুটবল বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা।

কিন্তু ফুটবল তাদের কাছে দায় মেটায়নি। ফুটবলের সবচেয়ে বড় পুরস্কার, সবচেয়ে বড় সম্মান বিশ্বকাপ জেতার সৌভাগ্য এঁদের কারওরই হয়নি।

ক্রিকেটেও এমন অনেক মেসি, ক্রুইফ, প্লাতিনি রয়েছেন। যাদের ক্রীড়াশৈলীতে বছরের পর বছর দর্শকেরা মুগ্ধ হলেও তাঁরা নিজেরা বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। সফল ক্যারিয়ারে এই একটা অপূর্ণতা থেকে গেছে তাঁদের। নামগুলো দেখলে কিন্তু চমকে উঠবেন যেকোনো ক্রিকেটপ্রেমীই।

গ্রাহাম গুচ

ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ইংলিশ ব্যাটসম্যান। ক্রিকেটকে কত কিছুই না দিয়েছেন! সুইপ শটের রাজা ছিলেন। ১৯৭৬ সালে প্রথম ওয়ানডে খেলা গুচ পরের ২০ বছর ইংল্যান্ডের অন্যতম ব্যাটিং স্তম্ভ হয়ে থাকলেও বিশ্বকাপ শিরোপাটা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেছে। বিশ্বকাপ জেতার কাছাকাছি গিয়েছিলেন! তিনবার ফাইনালে উঠেছেন, এর মধ্যে একবার আবার দলের অধিনায়ক হয়ে। কিন্তু তাও হয়নি। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের সেমিতে ভারতের বিপক্ষে গুচের সেঞ্চুরিটাকে এখনো ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবে মানা হয়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বাইশ হাজারের বেশি রান করার কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল!

ওয়াকার ইউনিস

ওয়াকার নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন। চোটে পড়ে দল থেকে বিদায় না নিলে ১৯৯২ বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান দলের অংশ হতেন তিনি। পরে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পেরে ওঠেনি পাকিস্তান। সেবার পাকিস্তানের বিশ্বকাপ দলে থাকলেও ওয়াকার খেলেছিলেন কেবল বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচটি। ২০০৩ বিশ্বকাপে অধিনায়ক হয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান বাদ পড়ে যায় প্রথম রাউন্ড থেকেই। পুরোনো বলে রিভার্স সুইং করানোকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এই পেসারের চেয়ে ওয়ানডেতে কেউ বেশিবার ইনিংসে পাঁচ উইকেট পায়নি। ইনিংসের শেষদিকের ওভারগুলোতে ওয়াকারকে খেলতেই পারতেন না ব্যাটসম্যানরা। সে ওয়াকারের কপালেই জোটেনি বিশ্বকাপ। 


ক্যালিস, লারা – দুজনের কারওর ভাগ্যেই জোটেনি বিশ্বকাপ। ছবি : টুইটার

ব্রায়ান লারা

ব্রায়ান লারা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। বিশ্বব্যাপী কত তরুণ যে শুধু লারাকে দেখে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছে, সেটি বলে শেষ করা যাবে না। ক্রিকেট সম্পর্কে যে কোনো খোঁজখবর রাখে না, সেও হয়তো বলতে পারবে, টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটা ৪০০ রানের, আর সেটি এই ক্যারিবীয় কিংবদন্তির। লারার কপাল খারাপ, বড্ড ভুল সময়ে জন্মেছিলেন। সাধারণ এক দলের একমাত্র অসাধারণ খেলোয়াড় তিনি একাই ছিলেন। ১৯৯২ বিশ্বকাপে দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন, তিনটি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন। কিন্তু সেমির খুব কাছে গিয়েও ফিরতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঝোড়ো এক সেঞ্চুরি করলেন, কিন্তু দলের বিদায় হলো সেমিফাইনাল থেকে, তাও নাটকীয় এক ম্যাচে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ছিলেন নিষ্প্রভ। সে কষ্টেই কি না, জীবনের শেষ বিশ্বকাপ শুরু করলেন সেঞ্চুরি দিয়ে, প্রতিপক্ষ সেই দক্ষিণ আফ্রিকা। কানাডা আর বাংলাদেশের বিপক্ষে দুটি মাঝারি মানের ইনিংসও ছিল তার। তাও প্রথম রাউন্ডে বাধা পেরোতে পারেনি উইন্ডিজ। ২০০৭ সালে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপটা নিজের মাঠে খেললেও প্রাপ্তি তাঁর শূন্যই।

ইয়ান বোথাম

সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডারের তালিকা করলে বোথামের নাম আসবেই। বল হাতে সব সময়ে কার্যকরী এই পেসার ব্যাট হাতে ছিলেন বিধ্বংসী। ১৯৮৭ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা ইংল্যান্ড দলেই ছিলেন না বোথাম। এর মধ্যে ১৯৯২ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলেছিলেন ১০ ম্যাচে পেয়েছিলেন ১৬ উইকেট। দল ফাইনালে উঠলেও বিশ্বকাপ জেতায় হয়নি তাঁর।

জ্যাক ক্যালিস

সর্বকালের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডারের কপালেও জোটেনি বিশ্বকাপ। বছরের পর বছর দলের মূল ভরসা হয়ে থাকা এই তারকা ব্যাট হাতে ওয়ানডেতে ১১ হাজারের বেশি রান করেছেন, বল হাতে উইকেট নিয়েছেন ২৭৩টি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেই ‘ভুতুড়ে’ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ‘টাই’ করে বিদায় নিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০০৩, ২০০৭, ২০১১, ২০১৫—এরপর চারটি বিশ্বকাপে তো প্রোটিয়াদের কপালে লেগে গেল ‘চোকার’ তকমা।

কুমার সাঙ্গাকারাএবি ডি ভিলিয়ার্স

কুমার সাঙ্গাকারা

২০১৫ বিশ্বকাপেই কুমার সাঙ্গাকারা টানা চার সেঞ্চুরি করেছিলেন। আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটিংকে এক অন্য পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ার যখন শেষ করলেন, ওয়ানডেতে শুধু শচীন টেন্ডুলকারের রান তাঁর থেকে বেশি ছিল। দুই বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলেছেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব গড় রেখেও দলকে ফাইনালে জেতাতে পারেননি সে দুবার। 

এবি ডি ভিলিয়ার্স

আধুনিক যুগের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার মানা হয় ভিলিয়ার্সকে। ব্যাটিং করতে গিয়ে এমন এমন সব জিনিস করে দেখাতেন, অন্য ব্যাটসম্যানদের দূরতম কল্পনাতেও যা ছিল না। বোলারদের পিটিয়ে সিধা করে ২০১৫ সালে উইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ৩১ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। ওয়ানডেতে ব্যাটিং গড় প্রায় ৫৪ রেখেও দলকে বিশ্বকাপ জেতানো হয়নি এই তারকার।


ওয়ালশ-অ্যামব্রোস  উইন্ডিজের এই দুই সারথিও থেকেছেন বিশ্বকাপ-হীন। ছবি : টুইটার

কার্টলি অ্যামব্রোস

শুধু ক্যারিবীয় ইতিহাসের নয়, বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই পেসার জেতেননি বিশ্বকাপ। বরাবরই ভীতিজাগানিয়া পেসার হলেও বিশ্বকাপ আসলেই কেমন যেন মিইয়ে যেতেন অ্যামব্রোস। আর লারার মতো সেই সমস্যাটা তাঁরও ছিল। উইন্ডিজ ক্রিকেট যখন অস্তাচলে, তখনই স্বর্ণসময় ছিল অ্যামব্রোসের।

সৌরভ গাঙ্গুলী

ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক তিনি। সৌরভের দেওয়া ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আর মহেন্দ্র সিং ধোনি বা বিরাট কোহলির দল হয়েছে বিশ্বসেরা। ২০০৩ বিশ্বকাপে একাই তিন সেঞ্চুরি করে দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আর জেতা হয়নি ভারতের। বিশ্বকাপে সৌরভের রেকর্ড অনন্য। ২২ ম্যাচ খেলে ৫৫.৮৮ গড়ে রান করেছিলেন ১ হাজার ৬। দুর্ভাগ্য, এত কিছু করেও দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি। সৌরভ অবসর নেওয়ার ঠিক পরের বিশ্বকাপটাই জেতে ভারত। সৌরভের অধিনায়কত্বে যেসব তরুণ তুর্কি গড়ে উঠেছিলেন, তারাই ভারতকে এনে দিয়েছেন বিশ্বকাপ। মাঝখান দিয়ে শূন্য হাতে ফেরত গেলেন শুধুই সৌরভ! 

সৌরভ গাঙ্গুলী

শহীদ আফ্রিদি

তখনো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আসেনি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সময়ের কথাই ধরুন। এই সময় ওয়ানডেতে যিনি টি-টোয়েন্টি স্টাইলে ব্যাটিং করতেন, তিনি পাকিস্তানের শহীদ আফ্রিদি। ৩৭ বলে সেঞ্চুরি করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাব। লেগ স্পিনটাও ছিল কার্যকরী। ব্যাটিং-বোলিং মিলিয়ে পাকিস্তান দলের বড় শক্তি হয়ে ছিলেন বহু বছর। ১৯৯৯ বিশ্বকাপ তাঁর ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ। দল ফাইনালে উঠলেও হেরে যায় অস্ট্রেলিয়ার কাছে। এরপর ২০০৩, ২০০৭, ২০১১ আর ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলেছেন। ২০১১ বিশ্বকাপে ছিলেন অধিনায়কই। পাকিস্তানকে তুলেছিলেন সেমিফাইনালে। কিন্তু দল হেরে যায় মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতের কাছে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে