বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন

অদ্ভুত একটা শব্দে চোখে লেগে আসা ঘুম ছুটে গেল মোবারক আখন্দের। মাঝরাত। আনুমানিক তিনটা। দেয়ালে ঘড়ি নেই। এখনো ঝুলানো হয়নি। এনার্জি বাতি জ্বলছে। চোখ কচঁলে বাতির দিকে তাকায়। বেচারা অসহায়ের মতো জ্বলছে। এই সময়ে তার জ্বলার কথা নয়। মোবারক আখন্দ সবসময় বাতি নিভিয়ে ঘুমান। কিন্তু আজ নেভালেন না। এর পেছনে বড় একটি কারণ আছে।

আজ বাসা পাল্টেছেন মোবারক আখন্দ। জিগাতল, ট্রেনারী মোড়। আগে থাকতেন মোহাম্মদপুর, তাজমহল রোড। স্ত্রী আছমা বেগম আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ে বিথীকে নিয়েই মোবারক আখন্দের সংসার। দীর্ঘ বিশ বছর পর বাসা পাল্টে তিনি বুঝতে পারলেন ঢাকা শহরে বাসা পাল্টানোর মতো কঠিন যজ্ঞ আর নেই। গত বিশ বছরে গৃহস্থালীর যে জিনিসটিতে একবারের জন্যও হাত পড়েনি যে জিনিসটাতে হাত দিতে হয়েছে। ঝেড়ে-মুছে বস্তায় ভরতে হয়েছে।

একসপ্তাহ আগ থেকেই আছমা আর বিথী কার্টুনের পর কার্টুন, বস্তার পর বস্তা করে স্তূপ যেন কারওয়ান বাজারের মনোহারী দোকানের আড়ত। মুখ ফসকে মোবারক আখন্দ জানতে চেয়েছিল এতোসব কী? হাড়ি পাতিল বস্তায় ভরতে ভরতে আছমা উত্তর দিয়েছিল- নড়া আর মরা সমান। প্রতি উত্তরে কিছুই বলেনি মোবারক আখন্দ। বলার মতো কোন শব্দ অথবা বাক্য ব্রেন থেকে তার মুখের জিহ্বা অবধি সাপ্লাই হয় নি। কথা এবং ভাষার সকল তাল-লয় হারিয়ে ফেলেছেন মোবারক আখন্দ।

‘অদ্ভুত শব্দটি কোথা থেকে এলো তার কোন হদিস পাওয়া গেল না’

ঘুমানোর চেষ্টা করছেন না। ঘুম একবার ছুটে গেলে পূনরায় তাকে ফিরিয়ে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়। বালিশ খাড়া করে বিছানায় হেলান দিয়ে পা টেনে বসলেন মোবারক আখন্দ। চোখ মুদলেন। তখনি পরপর দু’বার অদ্ভুত শব্দটি শুনতে পেলেন। চোখ মেলে তাকালেন এদিক-ওদিক। চারদিকে কার্টুন আর বস্তার ছড়াছড়ি। বাসা পাল্টানোর ভ্যানের লোকেরা তাজমহল রোডের বাসা থেকে নামিয়ে এখানে স্তূপ করে গেছে। জিগাতলা ট্রেনারী মোড়ের বাসায়। তাও বেলা তিনটে থেকে রাত সাড়ে এগারোটা বাজল। উফ। দীর্ঘ একটা বিরক্তির শ্বাস নিলেন। মানুষ যে কীভাবে বাসা পাল্টায়। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে থামলেন মোবারক আখন্দ। অদ্ভুত শব্দটি কোথা থেকে এলো তার কোন হদিস পাওয়া গেল না।

পাশের ঘরে মা-মেয়ে ঘুমোচ্ছে। সপ্তাহ ধরে গত বিশ বছরের সংসারের কৌটো, সুতো-কাপড় গোছাতে গিয়ে ওরা বেশ ক্লান্ত। পুনরায় চোখ সুদলেন মোবারক আখন্দ। বাসা পাল্টানোর কারণটা মাথায় ঝেখে বসল।

মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের বাসাটি ছিল তিন বেডের। সাথে ড্রইং-ডাইনিং। তিন বাথ। ঝকঝকে টাইলস। বারান্দা। দক্ষিণে খোলা জানালা। পাশে প্রশস্ত রাস্তা। খোলামেলা। আলো বাতাসে ভরপুর। দিনের বেলা বাতি জ্বালানোর দরকারই পড়তো না।

জিগাতলা, ট্রেনারী মোড়ের এই বাসাটি দুই বেড। এক বাথ। ড্রইং বলতে ছোট্ট একটু জায়গা। দু’টি চেয়ার আর একটা টেবিল ফেললেই হাটা-চলায় অসুবিধে হবে। রান্না ঘর ছোট। মেঝে খসখসে ফ্লোর। টাইলস নেই। বাথরুম পুরনো পলেস্তার ওঠা মোজাইক। কালচে রং। কমোডে মরচে পড়া দাগ। পানিতে আয়রন আছে। ভ্যাল্টিলেটর আছে কি নেই। চারদিকে উঁচু উঁচু দালান। গিজগিজ। এলোপাতাড়ি দাঁড়ানো। কোনটা আবার হেলানো।

ঘরের ভেতরটায় কতো বছর আগে চুনকামের প্রলেপ পড়েছিল বুঝা দুঃসাধ্য। ওঠার আগে একটু চুনকাম করে দিতে বলেছিল মোবারক আখন্দ। বাড়িওয়ালা বলেছিল টাকাটা মোবারককেই দিতে হবে। ওতেই চুপ হয়ে গিয়েছিলেন মোবারক আখন্দ। আছমা-বিথী খুব করে ধরেছিল চুনকাম করিয়ে নিতে। তিন বেডের বাসা ছেড়ে দু’বেডের বাসায় আসছে। একটু চুনকাম হলে ঘরটি চালিয়ে নেয়া যাবে।টাকার কথায় পিছু হটতে হলো মোবারক আখন্দকে। আছমাকে বলেছিল চালালেই চলে। আছমা চুপ করে গিয়েছিল।

প্রায় ত্রিশ বছর ঢাকা শহরে ভাড়া বাসায় থাকছে মোবারক আখন্দ। দশ বছর ব্যাচেলর আর বাকি বিশ বছর পরিবার নিয়ে। ব্যাচেলর থাকার সময় বেশ বাসা পাল্টাতে হয়েছে তাকে। সেই সময় থেকে বুঝেছে বাড়িওয়ালারা কতোটা খতরনাক হয়। বছর বছর ভাড়া বাড়ানো, হরেক রকম বিল, এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। রাত এগারটায় গেট বন্ধ। পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। সিঁড়ি ভাঙতে বেশি শব্দ করা যাবে না। আরো কতো নিয়ম কানুন। ভাড়াটিয়ারা টাকার বিনিময়ে থাকছে তা মনে হয় না। মনে হয় বাড়িওয়ালার দয়াতেই তাদের একটু আশ্রয় জুটেছে। তবে ব্যতিক্রম বাড়িওয়ালা দু’চার জন নেই তাও কিন্তু নয়।

বাসা পাল্টানোর কারণটা ভাবতে গিয়ে মোবারক আখন্দের বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে এলো। গুমরে কান্না এলে যেমন গলা ধরে আসে ঠিক তেমন গলা ধরে এলো। দু’চোখের কোণা ভিজে জল। আজ আঠারো মাস মোবারক আখন্দের চাকরি নেই। বেকার। দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপনে কাজ করতেন তিনি। চাকরির বয়সও কম নয়। পঁচিশ বছর। দুই যুগ পেরুনো।

চোখ না খুলেই এইটুকু জীবনের হিসেবটা মিলাতে চাইলেন মোবারক আখন্দ। বয়স এখন আটান্ন পেরিয়েছে। বাইশ কি তেইশ বছর বয়সে পত্রিকায় পার্ট টাইমার হিসেবে ঢুকেছিলেন। তখন জগন্নাথ কলেজে পড়তেন। বিজ্ঞান লেখা যোগাড় ছাড়াও কতো যে ফুট ফরমায়েশ খাটতে হতো। পাশাপাশি দু’টি টিউশনি। মেসে থাকার খরচ আর বইখাতা কেনার পয়সা ছাড়াও মধুমতি অথবা বলাকায় গিয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাসে অন্তত একটা সিনেমা দেখার পয়সা জুটে যেত।

সময়ের সাথে পত্রিকার কাজের অভিজ্ঞতাও বাড়তে লাগলো। কর্তৃপক্ষ ফুটফরমায়েশ খাটানো থেকে পদোন্নতি দিয়ে শুধু বিজ্ঞাপনের কাজে নিয়োগ দিলেন। একাজের কোন সময় অসময় নেই। বড় বড় ন্যাশনাল এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর দুয়ারে দুয়ারে দিয়ে বিজ্ঞাপন ভিক্ষা করা। কতো যে মিথ্যে কথা বলতে হতো।

পত্রিকা ছাপানো হয় সর্বসাকল্যে দশ হাজার কপি আর বিজ্ঞাপন দাতাদের বলতে হতো কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার কপি পুরো বাংলাদেশে যায়। তাছাড়া সপ্তাহের বিশেষ পাতাগুলোতো পাঠকরা সংগ্রহেই রাখে। সম্পাদক সম্পর্কেও দু’চারটা কতা বাড়িয়ে বলতে জিবে আটকাতো না। যেভাবেই হোক একটা বিজ্ঞাপন খসানোটাই কাজ। আর যখন একটা বিজ্ঞাপন হাতে আসতো তখন যেন আকাশের চাঁদ হাতে এলো। অনেক সময় মনে হতো আকাশের চাঁদ হাতে এলেও এতোটা খুশি হতাম না। বড় মুখ করে সম্পাদকের কাছেই নিয়ে যেতাম। সম্পাদক বাহবা দিতেন। আর বলতেন তোমাকে দিয়েই হবে। আরো ভালো করতে হবে। এই আরো ভালো করা ত্রিশ বছরের কর্মজীবনে শেষ হলো না। ভালোর শেষটা কোথায় অথবা তার সীমা-পরিসীমা কী এখনো জানা হলো না।

ঠিক ট্যাক ট্যাক। অদ্ভুত শব্দটি আবার হলো। মোবারক আখন্দের অতীত রোমন্থনে ছেদ পড়ল। চোখ খুললেন। তাকালেন এদিক-ওদিক। বেশ তেষ্টা পেয়েছে। গলার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে। টেবিলে রাখা বোতলে অর্ধেকটা জল আছে। আরো দু’টো পূর্ণ বোতল ছিল। ভ্যান ওয়ালারা সাবাড় করে গেছে।

বিছানা ছেরে টেবিলের কাছে গিয়ে জল পান করতে গিয়েও করলেন না। বাথরুমে গেলেন। ঘুম না এলে ঘন ঘন পেশাবের বেগ আসে মোবারক আখন্দের। ফিরে জল পান করলেন। বিছানায় বসতে যাবেন এই সময় শব্দটি হলো। বাতির দিক থেকেই এলো।

ইয়া বড় টিকটিকি। এনার্জির বাতির কাছেই। গিরগিটির মতো হা করে পোকা খাচ্ছে। এতো বড় টিকটিকি আগে কখনো দেখেনি মোবারক আখন্দ। টিকটিকির শব্দ খুবই পরিচিত তার কাছে। কিন্তু এই টিকটিকিটির ডাকটা কেমন যেন অদ্ভুত। খপ করে পোকা ধরছে আর গিলছে। মোবারক আখন্দ ভয় যেটুকু পেয়েছেন তার কিছুটা কমেছে। গভীর রাতে বাতাসে জানালার পর্দা নড়লেও ভয় হয়।

টিকটিকির খপ করে জীবন্ত পোকা গিলে খাওয়া আর পত্রিকা অফিসে মালিক কর্মচারীদের চাকরি খাওয়া একি মনে হল মোবারক আখন্দের। তিরিশ বছর চাকরি জীবনে তিনি অনেক মালিকের হয়ে কাজ করেছেন। তাদের বেশির ভাগই সমাজের বড় বড় শিল্পপতি। আর কর্মচারীরা হলো ভূখা-নাভার দল। পেটের দায়ে অন্যায়-অবিচার সহ্য করে। চাকরিতে ওম দেয়। কর্তর ইচ্ছেতেই কর্ম হয়। তারপরও সকাল বেলা সেজে গুজে অফিসে এসে দেখল চাকরি নেই। অথবা সন্ধ্যারাতে বাড়ি ফেরার সময় হাতে ধরিয়ে দিল পরদিন থেকে অফিসে না আসার টিকিট। সেই টিকিট হাতে ব্যর্থ মনোরথে বাড়ি ফেরে। বাচ্চার দুধের কৌটা। স্ত্রীর ফরমায়েশ, মরিচের গুড়ো, লবণ আর এক হালি ডিম আনতে ভুলে যায়। মুহূর্তে চাকরি নেই মানে পায়ে নিচের মাটি চোরাবালির মতো হঠাৎ করেই সরে যাওয়া।

একজন কর্মচারীর চাকরি নট করে দিতে বুক কাঁপে না শিল্পপতি মালিকের। কারণ চাকরি প্রার্থী হাজারো ভূখা-নাভার দল তাদের পায়ের কাছে লুটোপুটি খায়। ভূখার দলও যে ধোয়া তুলসি পাতা তাও কিন্তু নয়। তারা নিজেদের মধ্যেই দলাদলি করে।

মোবারক আখন্দ অনেক চাকরি নিজে ছেড়েছেন, আবার অনেক জায়গায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন। চাকরি জুটিয়ে নিয়েছেন। এসব লাইনে অভিজ্ঞ লোকের জায়গা তৈরিই থাকে। কিন্তু এবারের ঘটনাটা ব্যতিক্রম হলো। আঠারো মাস হয়ে গেল মোবারক আখন্দ চাকরি মেলাতে পারছেন না।

তাজমহল রোডের যে বাসায় দশ হাজার টাকা ভাড়াতে ঢুকেছিলেন তা বেড়ে হয়েছে পঁচিশ হাজার। নরমাল ফ্লোরটা বাড়িওয়ালাকে বলে নিজ খরচে টাইলস করে নিয়েছে। আত্মীয় স্বজনেরও যাওয়া আসা নিত্যদিন। মাসিক আশি হাজার টাকা বেতনের চাকরি। এর বাইরে আরো হাজার পঞ্চাশেক টাকার বাড়তি আয় সব মিলিয়ে বেশ ফুরফুরে সময় কেটে যাচ্ছিল মোবারক আখন্দ পরিবারের। স্ত্রী আছমা ও মেয়ে বিথীও আয়-রোজগারের সমানুপাতিক হারে চলাফেরায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। খরচের বাইরে বিভিন্ন একাউন্টে টাকাও জমতে লাগল।

ইতোমধ্যে কলিগ কামালের কাছে খবর পেলেন নতুন একটি পত্রিকা আসছে। নতুন পত্রিকার সম্পাদক চাইছেন মোবারক আখন্দ ইচ্ছে করলে জয়েন করতে পারেন। বেতন আশি থেকে বাড়িয়ে এক লাখ। পারসোনাল গাড়ি আর অন্যান্য সব সুবিধা।

মোবারক আখন্দ কলিগ কামালের অফারটা লুফে নিলেন। নামকরা জাতীয় পত্রিকায় রেজিগনেশান দিয়ে নতুন পত্রিকায় জয়েন করলেন। পদবি হলো বিজ্ঞাপন প্রধান। চার মাসের মাথায় পত্রিকার মালিক ফেরারি হয়ে গেল। চোরাকারবারি আর অবৈধ অস্ত্রের মামলায় দেশ ছেড়ে পালাল। পত্রিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বেতন বন্ধ।

রীতিমত হঠাৎ করেই বিপাকে পড়লেন মোবারক আখন্দ। ছোট-বড় অনেক পত্রিকায় ঢোকার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বিধি বাম। কাজের কাজ কিচ্ছু হলো না। কলিগদের মধ্যে জুনিয়রদের অনেকের কাছেই ধর্না দিলেন। তাদের অধীনস্থ হয়ে কাজ করতেও দ্বিধা করলেন না। হাতি গর্তে পড়লে চামচিকাও লাথি দিয়ে মজা নেয়। মোবারক আখন্দের বেলায়ও তেমনটি ঘটল। অধীনস্থরাও আশ্বাসের পিঠে আশ্বাস দিল আর নেপথ্যে হাসলো।

হঠাৎ করে চাকরি বেতন বন্ধ হলেও খরচের খাত কোনটা কমলো না। ব্যাংকে জমানো টাকা নদীর স্রােতের মতো শেষ হতে লাগলো। হন্যে হয়ে চাকরির সন্ধানে ছুটছেন মোবারক আখন্দ। কলিগ কামালের কথায় সাত-পাঁচ না ভেবে যে জাম্প দিতে গেলেন সেই অনুশোচনায় বেশ পান্তাচ্ছেন। এক দু’মাস করে বছর পেরিয়ে গেল। চাকরি মিলল না।

বাধ্য হয়েই আঠার মাসের মাথায় তাজমহল রোডের বিশাল বাসা ছেড়ে দিয়ে জিগাতলা ট্রেনারী মোড়ের দুই-বেডের অন্ধকার খুপড়ি বাসায় পরিবার নিয়ে উঠলেন মোবারক আখন্দ। খুব কাছের দু’একজন আত্মীয় ছাড়া অনেককেই জানালেন না। মনের ভেতরের চাপা কষ্ট কাউকে না পারছেন দেখাতে না পারছেন সইতে।

ছোট্ট দুই বেডের বাসাতে অনেক মালপত্র নিয়ে বিশ্রী রকম হিজিবিজিতে পড়ে গেলেন আছমা বেগম। মেয়ে বিথী মা-বাবা দু’জনকেই স্বান্তনা দেয়। বিথী বলে- আচ্ছা মা, তুমি এতোটা হতাশ হচ্ছো কেন? মানুষের সমসময় তো একরকম যায় না। চাকরির জন্য আমিও চেষ্টা করছি। টিউশন দু’একটা যোগাড় হয়ে যাবে। বাবার তো এখন আর আগের মতো চাপ নেয়ার বয়স নেই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আছমা বেগম বলেন- সবই বুঝিরে মা। কিন্তু প্রতিদিনের খরচ তো চাকরি আছে নেই বুঝে না। ভাত তো খেতে হবে। নাকি না খেয়ে থাকবি। কাল রাতে মহিলা সমিতির স্বপ্না ভাবী ফোন করেছিল। কাজের ঝামেলার কথা বলে এড়িয়ে গেছি। তো আর বলতে পারিনা আমাদের এই অবস্থা। এখন ভাবছি মোবাইল নাম্বারটাই পাল্টাবে হবে।

সপ্তাহ পেরিয়ে যায় নতুন বাসায়। সকাল হলে অফিসিয়াল জামা-কাপড় পরে বেরিয়ে যান মোবারক আখন্দ। সারাদিন এদুয়ার থেকে ওদুয়ারে ঘোরেন। আগে তাকে নিতে অফিসের গাড়ি এসে বসে থাকতো আর এখন কখনো পুরোটা পায়ে হেঁটে অথবা ট্যাম্পুতে চড়েই যান। ঢাকা শহরে রিক্শার ভাড়াও পকেটশুন্য করার মতো। ইতোমধ্যে একটা টিউশন যোগাড় করে নিয়েছে বিথী। পাঁচ হাজার টাকায় পুরো মাস পড়ানো। ওতে বিথীর নিজের পড়াশোনা আর ব্যক্তিগত কিছু খরচ তো চুকে যাবে। সাহস সঞ্চার হয় আছমা বেগমের মনে।

সামনের ছোট্ট ঘরটিতে মোবারক আখন্দ থাকেন। একা। ভেতর ঘরে মা-মেয়ে। মোবারক আখন্দের রাতের সঙ্গী সেই ইয়া বড় টিকটিকি। দিনের বেলা দরজার কোণা, কার্নিশ অথবা ভ্যান্টিলেটরের ছিদ্র থেকে ডাক দেয়। আর রাত হলে এনার্জি বাতির কাছে ওত পেতে থাকে। শিকার ধরে আর পেট ভরে।

প্রায় রাতেই ঘুম হয় না মোবারক আখন্দের। এ সময় টিকটিকির সাথে কথা বলেই পার করেন। নিঃসঙ্গতার এ দু’দিনে মোবারক আখন্দের ভালো বন্ধু হয় টিকটিকি। প্রতি রাতের মতো আজও টিকটিকির সাথে কথা বলছেন মোবারক আখন্দ। পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে আছমা বেগম ও বিথী।

আলাপটা বিথীকে নিয়েই হচ্ছিল। কাল দুপুরে খাবার টেবিলে আছমা বেগমই পেড়েছিলেন কথাটা। কয়েক মাস পরেই বিথীর অনার্স ফাইনাল। ওর কি এখন টিউশন করার সময়। মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে না? সত্যি ভাবনায় পড়ে যান মোবারক আখন্দ।
কী করা যায়?
টিকটিকি ডেকে ওঠে- ঠিক ট্যাক ট্যাক। অদ্ভুত ডাক।

এই এক সপ্তাহে টিকটিকির ডাক চেনা হয়ে গেছে মোবারক আখন্দের। কিন্তু এবারের ডাকটা সুবিধার মনে হলো না। তাহলে বিথীর বিয়ের কী হবে? মেয়েটা অনার্সে যাওয়ার পর থেকে কতো ভালো ভালো সম্বন্ধ এলো। ঘরের কেউ বিয়েতে মত দেয়নি। সবার এক কথা অনার্স শেষ হোক। কয় মাস পরেই তো অনার্স শেষ হতে যাচ্ছে। এখন কি আগের মতো ভালো সম্বন্ধ আসবে? গলি খুপড়িতে বাসার চেহারা দেখেই তো পিছু হটবে।

বিথীর মা বলেছিল ওর সাথে জামান নামে কে ছেলের সম্পর্ক চলছিল বেশ ক’মাস ধরে। জামান স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ড গেছে। তার কিছুদিন পর থেকেই নাকি যোগাযোগ নেই।

বিথীর নিজের ইচ্ছায় সে রকম একটা কিছু হয়ে গেলেও খারাপ হতো না। ভাবে মোবারক আখন্দ। কারণ বাসা ভাড়া দিয়ে, ঢাকা শহরে দিকে থাকার মতো সামর্থ্য দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। তার উপর মেয়ের বিয়ে নিয়ে খরচ করার মত কানাকড়িও নেই। ব্যাংকে এফডিআর যা ছিল তা ভেঙ্গেই চলছে সংসারের চাকা।

টিকটিকি ডেকে উঠল। মোবারক আখন্দ চোখ তুলে তাকালেন। হা করে আছে সে। জীবন্ত একটি পোকা গিলে খাওয়ার অপেক্ষায়। একি সাথে মোবারক আখন্দের জমি জিরাত ভাইদের গিলে খাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল।

বাবা-মা মারা গেছেন প্রায় এক যুগ পেরিয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মোবারক আখন্দ মেঝ। বড়জন সৌদিতে। ছোটজন ক্ষেতকর্ম নিয়া বাড়িতেই থাকছে। বাবা-মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরেই বাড়ি যাওয়া-আসা ছেড়ে দেন মোবারক আখন্দ। বিষয় ঐ একটাই। জমি-জিরাত নিয়ে বিরোধ। রাগের বশেই মোবারক আখন্দ ভিটে মাটি সব ভাইদের ভোগ করতে বলে বাড়ি ছেড়েছেন। আর ও মুখো হবার ইচ্ছে তার নেই। অথচ বড় ভাইয়ের সৌদি যাওয়া আর ছোট ভাইয়ের লেখাপড়া, হালের বলদ কেনার টাকা মোবারক আখন্দই যুগিয়ে দেন।

ভেতরটা কান্নায় মুচড়ে ওঠে মোবারক আখন্দের। ঢাকা শহরে ভাসমান উদ্ধাস্তুর মতো জীবনের প্রায় সবটুকুই শেষ হয়ে গেল। মানুষের গড় আয়ু কতো। ষাট। না হয় পয়ষট্টি, কী পেলাম? না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে পেট আর পিঠ বাঁচানোর যুদ্ধে বছরের পর বছর পার করেছি। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বিপদে হাত বাড়িয়েছি। চেয়েছি একটু যদি মানুষের ভালো করা যায়। হোক সে অনাত্মীয়। অন্তত একশো লোকের চাকরি দিয়েছি। একশো পরিবারকে বাঁচার অবলম্বন করে দিয়েছি। এখন তাদের কেউই আর কাছে আসবে না। ভাবতে পারেনা মোবারক আখন্দ। বিছানা ছেড়ে পায়চারী করে। টিকটিকিটা বাতির কাছে নেই। মনে হয় ঘুমোতে গেছে। মোবারক আখন্দ হা করে গলার ভেতর জল ঢালে। তারপর বিছানায় গিয়ে শোয়।

তিন মাস পেরিয়ে যায়। মোবারক আখন্দের চোখে চাকরির দেখা মেলে না। দিন দিন বাড়ে হতাশা। চোখে সর্ষেফুল দেখে। তবে আছমা বেগমের একটি কথায় কিছুটা স্বস্তি পায় মোবারক আখন্দ। যে বাসায় টিউশন করতে যায়, তার পাশের বাসার এক ছেলের সাথে ওর নতুন করে সম্পর্ক হয়েছে। আছমা বেগম নিষেধ করেছিল। মা-রে ওসবে আর জড়াস না। যা দিনকাল পরেছে এখন স্বয়ং আসমান থেকে ফেরেশতা নেমে এলেও ভরসা পাওয়া যাবে না।

আছমা বেগমের অস্থিরতায় মোবারক আখন্দ বলেছিলেন ঘর পোড়া গরু সিদ্ধঁবের মেঘ দেখলেও ভয় পায়। আছমা বেগমের আশংকাই ঠিক হয়েছে। রাত দশটা বেজে গেছে। বিথী ঘরে ফিরে নি। মুটোফোন বন্ধ, আছমা বেগম বিথীর টিউশনে ফোন করেছে। ওরা বলল বিথী আট-টার দিকেই বেরিয়েছে। তাহলে ও গেল কোথায়? মোবারক আখন্দ ও আছমা বেগম বেশ টেনশনে পড়ে গেল। কী করা উচিত, কাকে ফোন করা উচিত কিছুই মাথায় আসছে না। এমনি সময় দরজার আড়াল থেকে টিকটিকি অদ্ভুত শব্দে ডেকে উঠল। মোবারক আখন্দ বুঝে নিল কোন অশনি সংকেত।

ঝিম ধরে বসে থাকে বিছানায়। আছমা বেগম কাঁদছে আর পায়চারি করছে। টেনশন কাটানোর জন্য টেলিভিশন অন করে রাখে মোবারক আখন্দ। রাত বারটা পেরিয়ে যায়। নাওয়া-খাওয়া নেই। চুলোয় উনন জ্বলে নি। আছমা বেগমের পীড়ায় মোবারক আখন্দ একবার থানায় যেতে চেয়েও যায় নি। ভোর হোক। টিকটিকিটি বাতির কাছেই আছে। মুখ বন্ধ করে খাড়া বসে আছে। অনেক পোকা ওড়াউড়ি করছে। কিন্তু খপ করে গিলছে না। চোখ দু’টো মিটমিট করছে। টিকটিকির নীরব চেয়ে থাকা মোবারক আখন্দের মনের তোলপাড় বাড়িয়ে দেয়।

ভোর হয়। নির্ঘুম রাত পার করে মোবারক আখন্দ ও আছমা বেগম। দরজার ফাঁক গলে ভেতরে প্রবেশ করা সংবাদপত্র উঠিয়ে নেয় আছমা বেগম। মোবারক আখন্দের হাতে দেয়। প্রতিদিন সংবাদপত্র হাতে নিয়েই বিজ্ঞাপন দেখেন মোবারক আখন্দ। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে চাকরি করা প্রত্যেকেরই সংবাদের চেয়ে বিজ্ঞাপনে আগ্রহ বেশি। পত্রিকা খুলেই দেখতে চায় আজকে কোন কোম্পনী বিজ্ঞাপন দিল।

প্রতিদিনের মতো আজ বিজ্ঞাপনে চোখ গেলো না মোবারক আখন্দের। চোখ আটকালো একটি সংবাদে। ‘রাজধানীর ফার্মগেটে হোটেলে এক অজ্ঞাত তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যা।’ মোবারক আখন্দের হাত থেকে পত্রিকা পড়ে গেল। ছুটে এলেন আছমা বেগম। বুকে হাত চেপে কুঁজো হয়ে গেলেন মোবারক আখন্দ। চিৎকার দিলেন আছমা বেগম। টিকটিকি ধপাস করে দেয়াল থেকে মেঝেতে পড়ে দৌঁড় দিল।

একমাস হাসপাতালের বিছানায় থেকে হুইল চেয়ারে বাসায় ফিরলেন মোবারক আখন্দ। স্ট্রোকে বা পাশটা পূরো অবশ হয়েগিয়েছিল। এখন ধীরে ধীরে কিছুটা অনুভূতি পাচ্ছে। মিডিয়া, সংবাদপত্র কারো সাথেই কোন কথা বলেন নি। একমাত্র কন্যার নির্যাতন হত্যার জন্য থানায় মামলাও করেন নি। মোবারক আখন্দ মনের বুকে পাথর বেঁধে নিয়েছেন এই ভেবে- এদেশে প্রতিনিয়ত অনেক বিথী ধর্ষিত হচ্ছে। খুন হচ্ছে। একটি ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা অন্যটিকে চাপা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। এখানে বিচার চেয়ে অযথা আর দশজনের মতো হয়রানি হতে চায়নি মোবারক আখন্দ।

সময় গড়িয়ে যায়। অবশেষে একটি ফোন আসে মোবারক আখন্দের কাছে। পূর্ব পরিচিত একজন নতুন পত্রিকা বের করবে। বিজ্ঞাপনের দায়িত্ব নিতে হবে মোবারক আখন্দকে। অফিসেও হুইল চেয়ার থাকবে। গাড়ি থাকবে। ভালো বেতন থাকবে। আছমা বেগমের চোখে আবেগের জল। মোবারক আখন্দ রাজি হয়ে যায়। জীবনের ঘানিতো টানতে হবে। হুইল চেয়ারে গিয়ে অফিসে বসে। পুরনো কলিগ যাদের দুয়ারে ধর্না দিয়েও আশ্বাস ছাড়া কিছুই পায়নি তাদের অনেকেই আসে একটু সুযোগের প্রত্যাশায়। মোবারক আখন্দ অবাক তাকিয়ে থাকে দেয়ালে নীরব ঝুলে থাকা টিকটিকির দিকে।

লেখক পরিচিতি:

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন, জন্মগ্রহণ করেছেন ১১ নভেম্বর, চট্টগ্রামে। ২০০১ সালে নিশাচর আবেদ আলী উপন্যাসের জন্য বর্ষসেরা লেখক হিসেবে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কারের মধ্য দিয়ে তার লেখালেখিতে অভিষেক।

গল্প, কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটকসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ তার। ছাত্র অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেছেন। টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে তার রচিত একাধিক নাটক। তিনি গল্পকার নামে গল্পবিষয়ক পত্রিকার সম্পাদক।

অলংকরণ: আল নোমানের চিত্রকর্ম অবলম্বনে মীর রবি

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে