ঢাকা পড়ছে চীনের মুসলিম নির্যাতনের চিত্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

টাকার খেলায় ঢাকা চীনের মুসলিম নির্যাতনের চিত্র
চীন - সৌদি

বছর ঘুরে আবার এসেছে মুসলমানদের সংযম সাধনার মাস পবিত্র রমজান। তবে নিরন্তর চাপের মুখে থাকা চীনের মুসলিমদের জন্য এ মাসটা বয়ে এনেছে নতুন মাত্রার নির্যাতন।

অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, রমজানের ইসলামী রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে চীনা কর্তৃপক্ষ দেশটির উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেদের ইফতারের আগেই খেতে বাধ্য করছে, না খেলে নেমে আসছে শাস্তির খড়গ।

মিউনিখভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড উইঘুর কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট দোলকুন ইসা বলছেন, এ ব্যাপারটা খুবই কষ্টদায়ক, আমাদের সম্মানে সরাসরি আঘাতও করে।

চীনের পশ্চিমাঞ্চলের শিনজিয়াং প্রদেশের মুসলিমদের কিভাবে রমজান মাসে দিনের বেলা রেস্তোরাঁ খুলে রাখতে বাধ্য করা হয় এবং চীনা মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুপুরের খাবারের বিরতির সময় সেখানে কর্মরত উইঘুর শ্রমিকদের খেতে বাধ্য করা হয়, তাও উঠে এসেছে ইসার কথায়।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো নিশ্চুপ

কিছু বললে পাছে চীন মনোক্ষুন্ন হয়- খুব চিন্তা করে এমন হিসেব-নিকাশ করে উইঘুরদের ওপর চলমান চীনা নির্যাতনের বিষয়ে টু শব্দ করছে না মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো। বিষয়টা নিয়ে মুসলিম দেশগুলোর চেয়ে বরং পশ্চিমা দেশগুলো ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বেশি সরব।

চীনের প্রতি মুসলিম দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে- তা মূলত নির্ধারণ করে দেয় ধর্মীয় ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব। ইসলামে পবিত্রতম দুটি স্থান বলে বিবেচিত দুই মসজিদের রক্ষকও হলেন দেশটির বাদশাহ। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনৈতিক চাকার অপরিহার্য অংশও এই সৌদি, এ দেশের তেলেই চাকা ঘোরে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির।

সিনহুয়া নিউজ এজেন্সির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি মাসে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে সৌদি বাদশাহ সালমানের। সেখানে সবক্ষেত্রে নিজেদের সম্পর্কন্নোয়নের কথাই বলেছেন বাদশাহ সালমান। চলতি বছরের শুরুর দিকে বাদশাহ সালমানের ছেলে যুবরাজ মোহাম্মদ চীন সফরে যান। সেখানে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি উপেক্ষা করে তিনি জিনপিংকে বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সন্ত্রাস দমনে এবং সন্ত্রাসবিরোধী যেসব পদক্ষেপ চীন নিয়েছে, আমরা সেগুলোকে সমর্থন করি এবং সম্মান জানাই।

বন্দিশিবিরে প্রায় ৩০ লাখ উইঘুর মুসলিম

সম্প্রতি পেন্টগনের এক কর্মকর্তা হিসেব করে দেখেছেন শিনিজিয়াংয়ের বিশাল বিশাল সব বন্দিশিবিরে প্রায় ৩০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। তবে চীন সরকার বলে থাকে এগুলো আসলে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, উগ্রবাদ থেকে দূরে রাখতে এ পদক্ষেপ। তবে সেখানে যারা রয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা বলেন ভিন্ন কথা। পশ্চিমা দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে, এটা আসলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জাতিটিকে নির্যাতনের একটা নিয়মতান্ত্রিক প্রয়াস এবং তাদের ইসলাম বিচ্যুত করার চেষ্টা।

পুরুষদের অনেককে জোরপূর্বক দাড়ি কাটানো হয় এবং নারীদের হিজার পরার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অনেক মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে। গোটা শহরের ওপর রয়েছে সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং রমজানে সেসব নিয়ম-কানুন রয়েছে সেগুলো ভাঙার প্রবণতা এ বছর বাড়ানো হয়েছে।

গত ৬ মাসে এসব প্রচার-প্রচারণায় অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি) সদস্য দেশগুলোর দিকেই বেশি দৃষ্টি ছিল চীনের। সবকিছুর জন্য চীন খুব বেশি নির্ভর করেছে সৌদি আরব ও তার প্রভাবশালী মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওপর।

উইঘুরদের সংকটাপন্ন দশা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া দেশ সৌদি একাই নয়। পাকিস্তান, ইরান এবং মিসরের মতো দেশগুলোও এ বিষয়ে চুপ থেকেছে বরাবর। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাকি দেশগুলো চুপ থাকলেও সৌদির নীরব থাকাটার একটা আলাদা মাত্রা রয়েছে। কারণ, দৃশ্যত মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে সৌদি আরব।

বেইজিংয়ের কূটনীতিকদের মতে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ে চীন বিশেষভাবে সংবেদনশীলতা দেখিয়েছে। কূটনীতিক হয়ে বিষয়টি নিয়ে সরাসরি গণমাধ্যমে কথা বলতে না পারার বাধা থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কূটনীতিক বলেছেন, অনেক মুসলিমদেশই এ বিষয়ে খুব ভালোভাবে ওয়াকিবহাল কিন্তু এর বিরোধিতায় নেতৃত্বে দিতে তাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে, কারণ এর ফলে চীন থেকে তাদের দেশে হতে যাওয়া সম্ভাব্য বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

গ্লোবাল বেল্ট এবং অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে চীন বেশ কিছু মুসলিম দেশসহ ৬০টি দেশে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। মালয়েশিয়া, ইরান, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশেও দ্রুতগতির রেল লাইন, সমুদ্র বন্দর এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে কাজ করছে। চীনের বিভিন্ন প্রকল্পে আগ্রহ রয়েছে মিসর এবং ইরাকেরও।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চীনের গৃহীত এ পরিকল্পনা সফল হচ্ছে।

বহু বছর নীরব থাকার পর উইঘুরদের ওপর চলমান নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা বন্ধের দাবি জানায় তুরস্ক। প্রতিক্রিয়ায় উইঘুরদের তুর্কি বলে দাবি করে বসে চীন।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ফোর্স এয়ার ওয়ার কলেজের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটিজ স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ডন সি. মারফি বলছেন, সৌদির প্রথম স্বার্থ হলো অর্থনীতি। তেল বিক্রি।

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে চীনই এখন সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারক। ২০১৮ সালে চীন সৌদি আরব থেকে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য আমিদানি করেছে। এ বছরে দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।

সৌদি আরব চীনের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বাজার। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদিই হলো চীনা পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের সাথে এখন একটা বাণিজ্য চুক্তির পথে রয়েছে চীন, এ জোটের সবচেয়ে বড় সদস্য হলো সৌদি আরব।

২০১৩ সালে শি জিনপিং চীনের ক্ষমতায় আসার পর দেশ দুটির অর্থনৈতিক সম্পর্ক আগের চেয়ে বিস্তৃত হয়েছে। ২০১৬ সালে দেশ দুটি তাদের সম্পর্ক ‘ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করে। সৌদি অর্থনীতিতে বৈচিত্রতা আনতে যুবরাজ মোহাম্মদের ভিশন ২০৩০ ও অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারে জিনপিংয়ের যে স্বপ্ন রয়েছে তার মধ্যে ভিন্নতা কমই রয়েছে।

চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের ইন্সটিটিউট অব ওয়েস্ট-এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো হি ওয়েনপিং বলছেন, গত বছর ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার পর সৌদি কূটনৈতিকভাবে যে সংকটের সময় পার করেছে, তা কাটিয়ে উঠতে চীনের সঙ্গে সৌদির শক্ত একটা সম্পর্ক খুব কার্যকরী হবে।

জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সারা বিশ্ব থেকে সমালোচনার আওয়াজ উঠলেও বেইজিংয়ের চুপ থাকা রিয়াদের প্রশংসা পেয়েছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গালফ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিষয়ে বিশ্লেষক জিওরজিও ক্যাফিইয়েরো মনে করেন, চীন ভ্রমণে লাল গালিচা সংবর্ধনা পাওয়া খাশোগি হত্যাকাণ্ডে তাদের কিছু যায়-আসে না। আর খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর চীন নীরব থেকে সৌদির যে উপকার করেছে উইঘুর মুসলিমদের বিষয়ে চুপ থেকে সৌদি তার প্রতিদান দিচ্ছে। এ দুটি দেশই খুব বুঝে-শুনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পা বাড়ায়। এ দুই দেশেই মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না, আর তারা চায় না এটা নিয়ে কেউ বেশি মাথা ঘামাক।

সূত্র : এনডিটিভি।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে