মিয়ানমারের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করলেও এখন আর তাদের জন্য সরকারের কোনো খাদ্য সহায়তা দিতে হয় না।
বিভিন্ন দেশ এবং দাতা সংস্থা এখন সাহায্য দেয়ায় বাংলাদেশ এ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এমনকি এ দেশের জনগণের দেয়া বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী ১৪টি গোডাউনে রয়ে গেছে। ২০১৭ সালের পর সরকার তাদের জন্য ৫০০ টন চাল বরাদ্দ দেয়। সেখান থেকে মাত্র ১০ টন খরচ হয়েছে।
সস্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তৃতীয় বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়। বৈঠকে এ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. শাহ্ কামাল একটি পাওয়ার পয়েন্টে এসব তথ্য জানান।
বৈঠকে কার্যপত্র থেকে জানা যায়, অতিরিক্ত সচিবের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬) বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সহায়তা কার্যক্রমে খুবই আন্তরিক। কিন্তু মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে প্রচুর জায়গা আছে, সেখানে তাদের পুনর্বাসনে এদের তেমন আগ্রহ দেখা যায় না।
জাতিসংঘ কেন চেষ্টা করে না, সেখানে আমাদের কি করণীয় আছে সভাপতি জানতে চাইলে সিনিয়র সচিব বলেন, গতবছর জাতিসংঘে রোহিঙ্গাদের ইস্যু বার বার উপস্থাপিত হয়। বার বার চীন ভেটো দেয়। চারটি বৈঠক হয়েছে প্রত্যেকটিতে চীন ভেটো দিয়েছে।
এ বিষয়ে সিনিয়র সচিব মো. শাহ্ কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, সংসদীয় কমিটির বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন বিষয়ক (মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত) কার্যক্রম সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগের যারা ছিল তাদের নিয়ে বর্তমানে মোট ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির দুই থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল, নয় কেজি ডাল ও তিন লিটার ভোজ্য তেল দেয়া হচ্ছে। চার থেকে সাত সদস্যের পরিবারের জন্য জন প্রতি মাসে ৬০ কেজি চাল, ১৮ কেজি ডাল ও ছয় লিটার ভোজ্য তেল এবং আট এর অধিক সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ১২০ কেজি চাল, ২৭ কেজি ডাল এবং ১২ লিটার ভোজ্য তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি প্রতি মাসে দুই রাউন্ডে খাদ্য সমগ্রী বিতরণ করে।
সিনিয়র সচিব আরও বলেন, এ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ৫০০ টন চাল বরাদ্দ হয় রোহিঙ্গাদের জন্য। সেখান থেকে মাত্র ১০ টন খরচ হয়েছে। এটা ২০১৭ সালে আর বাকিগুলো এখন আর প্রয়োজন হয় না। কারণ বাংলাদেশের জনগণ প্রাথমিকভাবে যে পরিমাণ সাপোর্ট দিয়েছে তাতে ১৪টি গোডাউনে বিভিন্ন খাদ্য সামগ্রী রয়ে গেছে। এ ছাড়া অন্যান্য এজেন্সি যে সাপোর্ট দিচ্ছে তাতে আমাদের সহায়তার প্রয়োজন পড়ে না।
দেয়া হচ্ছে বিদ্যুৎ সংযোগ, স্থাপন হচ্ছে সৌরবাতি
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে উখিয়ার কুতুপালং-বালুকালী নতুন ক্যাম্প এলাকায় প্রস্তাবিত ১৩ কিলোমিটার লাইন নির্মাণের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। আরও চার কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন স্থাপনের কাজ শিগগিরই শেষ করতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নতুন ক্যাম্প এলাকায় ৫০টি সড়ক বাতি ও ১০টি ফ্লাড লাইট স্থাপন করেছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় ইতোমধ্যে ২ হাজার ১৯টি সৌরবাতি স্থাপন করা হয়েছে।
সিনিয়র সচিব মো. শাহ্ কামাল বলেন, সবগুলো ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৭১টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৭টি অগভীর নলকূপ, ৩ হাজার ৬৩২টি গভীর নলকূপ ও ১১টি কুয়া স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া উখিয়ার কুতুপালং-বালুখালী নতুন ক্যাম্প এলাকার ১২ নং ক্যাম্পে জাইকা, আইওএম ও ডিপিএইচই’র যৌথ উদ্যোগে ৩০ হাজার লোকের জন্য পানি সরবরাহের উপযোগী ১ হাজার ৪০০ ফুট গভীরতাসম্পন্ন একটি বৃহৎ নলকূপ স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
রোহিঙ্গাদের বাংলা শিক্ষা নয়
সচিব আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য ৩২৭১টি শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও ৫৪২৮ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ১৪ বছরের কম বয়সী ১ লাখ ৭৭ হাজার ৭২৫ বালক-বালিকাকে। এসব শিক্ষা কেন্দ্রে মিয়ানমার ও ইংরেজি ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। তাদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না।
প্রত্যাবাসন নিয়ে যা জানানো হলো কমিটিতে
সংসদীয় কমিটিকে জানাতো হয়, চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৮০৩২ জন রোহিঙ্গা নাগরিকের তথ্যাদিসহ তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মিয়ানমারে পাঠানো হয়। এরপর ২০ দফায় ৭০১৫ জনের একটি তালিকা মিয়ানমার পরীক্ষা করে হস্তান্তর করেছে।
তারমধ্যে ৪৯৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার বসবাসকারী, ২০০৫ জন মিয়ানমার নিবন্ধিত পরিবারের তালিকাভুক্ত নয়, ৬০ জনকে সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকভূক্ত করে যাচাইন্তে বাংলাদেশে প্রেরণ করে। প্রত্যাবাসনের চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ক্যাম্প পর্যায়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।
কিন্তু চুক্তিতে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের শর্ত থাকায় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার অভাব ও নাগরিকত্ব প্রদানের নিশ্চয়তা না দেয়ায় কোনো রোহিঙ্গা নাগরিক স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি হয়নি। প্রত্যাবাসনে রাজি করানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মপকিল্পনা/কার্যক্রম গ্রহণ করা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।