দেড় বছরের মিশায়েলকে তার অন্ত্রনালীর ক্যান্সারের জন্য এ পর্যন্ত পাঁচবার অপারেশান করতে হয়েছে। তার ক্ষুদ্রান্তটি আট সেন্টিমিটার কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। কিন্ত এতগুলো অপারেশানের পরও তার জীবনের কোনই আশা নেই। হাসপাতাল থেকে আমি যখন ষ্টেসান-সিসটারের টেলিফোন পেলাম, তিনি এ আশংকাটি জানিয়ে বললেন মিশায়েলের বাবা মা খুবই হতাশ ও দিশাহারা হয়ে পড়েছে।
হাসপাতালের ইন্টেনসিভ বিভাগে গিয়ে দেখি মিশায়েল তার লোহার উঁচু জালে ঘেরা বিছানায় চিৎ হয়ে দুপাশে হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছে। পাশে মেঝেতে একটা তক্তপোষে ওর বাবা শুয়ে আছে। দিনে রাতে সব সময় সে আর তার স্ত্রী পালা করে মিশায়েলের বিছানার পাশে থাকে। বাবার বেশ শান্তভাব দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। উনি প্রথমে মিশায়েলের রোগের ইতিহাস আমায় বর্ণনা করলেন। তারপর বললেন, তিনি ও তার স্ত্রী মিশায়েলকে কত ভালোবাসেন। এ সন্তানটির গুরুত্ব তাদের কাছে বিশেষ এবং ভিন্ন। তাদের অন্য দুটি সন্তানের ১২ ও ১০ বছর বয়স।
মিশায়েলের জন্ম হয়েছে অনেক পরে। ও হল তাদের, যাকে লোকে বলে, রবিবারের সন্তান (ইশ্বরের একান্ত আশীর্বাদপুষ্ট)। সে রবিবারের সমস্ত আনন্দ আর সজীব প্রাণবন্যা নিয়ে তাদের ঘরে বিধাতার বিশেষ উপঢৌকন হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। বাড়িতে যেমন, এখানেও হাসপাতালে সে সবার প্রিয়। এই ছোট্ট শিশুটির এখনই এত প্রাণশক্তি যে তার মধ্যে একটা চোখে পড়ার মত ব্যাক্তিত্ব অনুভব করা যায়।
এ সব বলতে গিয়ে বাপের গর্বে বুকটা ফুলে উঠছিল। তার চোখে অপ্রতিরোধ্য জল। কিন্ত এখন মিশায়েল বিবর্ণ এবং শক্তিহীন। কোনমতেই সে তার ভাল চোখটিও খুলতে পারছিল না। আরেকটি চোখ ফুলে গিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
সে শ্বাস নিতে গিয়ে হাপাচ্ছিল। মনে হল আমার আত্মা তার দুঃখে বিদ্ধ হয়ে গেছে। আমারই এত কষ্ট হচ্ছে ওকে দেখে। বাবা মা’র বেদনা তো আরও শতগুন বেশি! বিধাতার দেয়া সন্তানকে আবার দেড় বছর পরেই ফিরিয়ে দিতে কোন বাবা মাই বা চাইবে?
একদিন পর আবার হাসপাতাল থেকে ফোন এল। এখন মা এখানে। আজ সকালে উনি স্বামীর কাছে শুনেছেন, মিশায়েলের আর কোন আশা নেই। শুনেই পাগলিনীর মত দিশাহারা হয়ে গেছেন। আমি ভাবতেই পারিনি অভিযো, বিরক্তি আর অনুযোগের এমন একটি অগ্লুৎপাত হাসপাতালে অপেক্ষা করছে! আমি যেই তাকে অভিবাদন করে বলেছি, বিধাতার ইচ্ছাই পুর্ণ হবে। উনি প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়লেন।
আহা! বিধাতার কথা আর আমাকে বলবেন না। দয়া করে কোন রূপকথা শোনাবেন না। আমি জানি ওই সব বাইবেল আর ঈশ্বরের মধ্যে আসলেই কি আছে। সব মিথ্যা, ভণ্ডামী আর প্রতারণা। একেবারেই সব ভ্রান্ত। নাকি আপনার কাছে এর কোন সঠিক ব্যাখ্যা আছে? এটা তো পুরোপুরিই উদ্ভট! প্রতি রবিবারে আমি নিয়মিত গীর্জায় যাই, আমি আজন্ম বিশ্বাসী খৃষ্টান। সব সময়-ভালোবাসার প্রতীক-প্রিয় বিধাতায় বিশ্বাস করেছি। এটাই কি আমার জন্য তার ভালোবাসার ফলাফল? দেখুন, ভালো করে দেখুন, আমার প্রাণপ্রিয় ছোট্ট বাছাটি কিভাবে মারা যাচ্ছে! তাকে মেরে ফেলে আপনার বিধাতার কি লাভ? সে কেন আমাদের আদরের সন্তানটি কেড়ে নিচ্ছে?
তার প্রতিটি কথাই মনে হল আমার মাথায় এক একটি প্রচণ্ড মুষ্ঠ্যাঘাতের মত নেমে এল। অনেকটা বুদ্ধিভ্রষ্টের মত আমি ওখানে দাাঁড়িয়ে রইলাম। না, আমার তার প্রশ্নগুলির কোন উত্তরই জানা ছিল না। একটি ব্যাখ্যাও আমার মাথায় এল না।
আমার ভেবে একটু স্বস্তি হল যে- আমি আজ প্রথমবার এ কক্ষে এসে মিশায়েলকে দেখছি না। আমার সামনে একটা ক্রোধী, আহত এবং হতাশ মুখ। তার দুচোখে শুধুই বিরাগ আর বিক্ষোভ। মনে হল এসব কিছু থেকে ঘৃণা অল্প দূরেই ওৎ পেতে আছে। মস্তিস্ক বিকৃতির আরম্ভ কি এভাবেই হয়? আমি একটু শিউরে উঠলাম।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে মিশায়েলের ছোট্ট হাত দুটি বুলিয়ে দিতে থাকলাম। আমার যা বোধ হল- তাই মনে মনে বললাম, আমি এতটাই অক্ষম যে আমি বুঝে উঠতে পারছি না, তার প্রশ্নগুলির কোন উত্তর আমার কাছে নেই কেন? আমারও এই অসহায় শিশুটিকে দেখে ব্যাথা লাগছে। এ সময়ে সাধারণত পাদ্রীরা যা করে থকে, একটি প্রার্থণা করার সাহসও আমার এখন হল না।
- আরও পড়ুন>> বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি
দু’দিন পর, মঙ্গলবার দুপুরে আমি আবার টেলিফোন পেলাম। মিশায়েল শীঘ্রই মারা যাবে। আমি কামরায় ঢোকার পর একজন সম্পূর্ণ নতুন পরিবর্তীত মা’কে দেখতে পেলাম। মুখমণ্ডল অশ্রুসিক্ত, কিন্ত শান্ত। আমরা যখন করমর্দন করলাম, উনি আমার দিকে সহৃদয় চোখে সহাস্যে তাকালেন। আমিই চেয়েছি যে আপনি আবার একবার মিশায়েলের কাছে আসুন, তিনি বললেন। আমরা দু’জনেই ছোট্ট বিছানাটির দিকে তাকালাম। কিন্ত এবার আমাদের উভয়ের দৃষ্টিই দু’দিন আগের থেকে অনেক আলাদা।
মা আবার বললেন, মিশায়েল তাদের কত আদরের সন্তান। সে তাদের কত আকাঙ্খিত। পেটে আসার পর উনি কীভাবে প্রতিদিন তাকে প্রসব করার শুভক্ষণটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন। আগত দিনগুলির জন্য তার খুবই ভয়। যখন ও আর তার কাছে থাকবে না। তবে উনি এখন অন্য আরেকটি দিকও দেখতে পারছেন। যখন অন্ত্রনালি আর নতুন করে বাড়বে না, যা কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে, সে জন্য মিশায়েলকে আজীবন শরীরে একটা বোতল বইতে হবে। যেখানে তার দরকারি সবকিছু দিন আর রাত ভরে রাখতে হবে। সে যখন অন্য বাচ্চাদের মত হাঁটতে বা লাফাতে পারবে না, তাহলে বোধহয় এটাই ভালো, ও চলে যাক।
আমরা তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ কথা বার্তা বলার পর, আমি বললাম, আমি মিশায়েলকে সানন্দে শেষ-আশীর্বাদ করতে চাই। কিন্ত আমি জানি না আপনার তাতে মত আছে কি না। উনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
আমি মিশায়েলের খড়ের মত এলোমেলা সাদা চুলের মধ্যে তার তালুতে আমার ডান হাত রাখলাম। মনে হল সে তখন বিরতি দিয়ে ছোট ছোট নিঃশ্বাস নেবার জন্য আকুপাকু করে বাতাস খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমি চেষ্টা করলাম আমার মন থেকে কিছু কথা বের করতে।
কিছুটা থেমে থেমে বললাম, প্রভু, আমরা এখানে মিশায়েলের বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের পূর্ণ অক্ষমতা উপলব্ধি করছি। তার এত মর্মান্তিক কষ্ট হচ্ছে। আমরা সবাই নিরুপায় হয়ে দেখছি। আমাদের কারো কোন শক্তি নেই ওকে সাহায্য করার। এটা একটা অসহ্য, অবর্ণনীয় যন্ত্রণা। প্রভু, প্রশ্ন অনেক কিন্ত উত্তর খুব কম।। তবে সব সময় একটাই বড় প্রশ্ন, কেন? প্রভূ, যদিও তুমি আমাদের জন্য মোটেও সহজ করে দাওনি তবুও এটা আমাদের কোন স্পর্ধা নয় যে আমরা আশা করি ও ঐকান্তিকভাবে বিশ্বাস করি মিশায়েলকে তুমি সেই সমস্ত মহাত্মাদের সাথে স্থান দেবে, যারা তোমার অত্যন্ত প্রিয়। তাকে তোমার কোলে তুলে নাও, প্রভু।
যারা এখানে তাদের হৃদয়ে মিশায়েলকে স্থান দিয়েছে, যারা তোমাকেও ভালোবাসে তাদেরও তুমি তোমার দয়ার ছায়ায় স্থান দাও। আমরা তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মাত্র অল্প সময়ে এই শিশুটি অনেককেই মধুর আনন্দ দিয়েছে। প্রভু, তোমার হাতটি তার এবং তার মৃত্যুর পথের উপর রাখো। কারণ মিশায়েলও সেই দলে যারা বলে, প্রভু, তুমি আমাদের নাম ধরে ডেকেছো, আমরা সবাই তোমার।
প্রার্থনার পর আমি তার ছোট্ট কপালে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে দিলাম। কপালটি এখনও গরম কিন্ত চকের মত সাদা। মাকেও অনুরোধ কললাম তার কপালে ক্রুশ আঁকতে। তারপরই আবার একবার শোকের ঢলটি নেমে এল।
আসন্ন সন্তান হারানোর ব্যাথা, অন্তহীন দুঃখ আর বেদনায় উনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলেন। আমারও দু’চোখে অশ্রুর ধারা। তবে এত শোক ব্যাথা আর আহাজারির মধ্যেও একটা সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত বোঝা যায়। একটি তৃপ্তির ছোঁয়া। সংকটের অবসানের প্রারম্ভ। আমরা দুজনেই এটা বুঝতে পারলাম, অনুভব করলাম। যা অপ্রতিরোধ্য, তাকে স্বীকার করে নেবার জন্য আমাদের দুজনের একটি সংহতি। সেদিনই মিশায়েল মারা গেল।
লেখক পরিচিতি:
আবদুল্লাহ আল হারুন, বোহেমিয়ান লেখক। প্রায় চার দশক ইউরোপ প্রবাসী। বর্তমানে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের নিকটবর্তী নয়ে-ইজেনবর্গ শহরে থাকেন। জন্ম ১৯৪৫ সালে, রাজশাহীতে। বেড়ে উঠেছেন জামালপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ শেষ করেন ‘৬৮ সালে।
পাবনার একটি কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু। ‘৭৭ সাল অবধি কখনও আমলা, কখনও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা। ‘৭৭ সালের অক্টোবরে দেশত্যাগ, প্রথমে গ্রিস, তারপর জার্মানি। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থনা মঞ্জুর ‘৮৫ সালে। ‘৯৩ সালে পান জার্মানির নাগরিকত্ব। প্রবাসজীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরা। আছে দীর্ঘ বেকারত্ব, হোটেলে বাসন-কোসন ধোয়া, কাপড়ের মিলে শ্রমিক, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট অফিসের কেরানি, হোটেলের নাইট অডিটর, প্যাকার, স্টোরকিপার, সুপারভাইজারসহ নানা রকমের পেশার অভিজ্ঞতা। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে চলে যান সুইজারল্যান্ড।
সেখানে তিনি অ্যাঙ্গেলবার্গের একটি হোটেলে এবং পরে দাভোজের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাত তারা হোটেল গ্র্যান্ড স্টাইগেনবার্গার বেলভেদরে চাকরি নেন। সেখানে তিনি বিল ক্লিন্টন, নেলসন ম্যান্ডেলা, কফি আনান, পিটার উস্তিনভ, পল ম্যাকার্টনি, ম্যাডোনা, রোমান পোলানস্কি, বিল গেটস, টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস প্রমুখ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। জার্মানিতে ফিরে আসেন ২০০৫ সালে। বিচিত্র ও চমকপ্রদ এসব অভিজ্ঞতা তাঁর লেখার অনুপ্রেরণা। মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ সময়ে সঙ্গ দেয়ার ইউরোপিয়ান সংগঠন হজপিসের সক্রিয় সদস্য তিনি।
সুযোগ পেলেই সানন্দে মৃত্যুসঙ্গ দেন। মৃত্যুসঙ্গ ও মৃত্যু নিয়ে লিখেছেন- জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন, মৃত্যু: একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা এবং মত্যসঙ্গীর দিনলিপি এ চারটি বই। ২০০৮ সালের একুশে বইমেলায় প্রথম বই প্রবাসে দৈবের বশের প্রকাশ উপলক্ষে দেশে এসেছিলেন দেশত্যাগের ত্রিশ বছর পর। ২০১০ সালের নভেম্বরে অবসর জীবনের শুরু। সময় পেলে অনুবাদ কাজও করে থাকেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কাজের মধ্যে রয়েছে- সুইডিশ উপন্যাস সিটি অব মাই ড্রিমস [ইংরেজি থেকে বাংলা], হার্টা ম্যলারের উপন্যাস- আটেমসাউকেল [জার্মান থেকে বাংলা], টনি ব্লেয়ারের দি জানি, জন পার্কিনসনের– দি কনফেসনস অব এন ইকোনোমিক হিটম্যান [ইংরেজি থেকে বাংলা] ইত্যাদি। রবীন্দ্রসংগীতের বিশেষ অনুরাগী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়, বড় ভাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যজন আবদুল্লাহ আল-মামুন।
অলংকরণ: Noel Naiglin এর চিত্রকর্ম অবলম্বনে মীর রবি