দশ নাম্বার থেকে বাসে উঠলেন আনফর। সন্ধ্যা সাতটা। বাসে প্রচণ্ড ভীড়। উঠতে সাহসই পাচ্ছেন না। ধুলায় কুয়াশার মত প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে মিরপুর দশ নাম্বার এলাকা। ভাবছেন আজকে বাসায় যেতে ক’টা বাজে কে জানে। হুট করেই একটা ধাক্কা খেলেন। একজন মধ্য বয়সি মেয়ে। ধাক্কা দিয়েই কোনো কিছু না বলে আনফরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটির হাতল ধরে ঝুলে গেলো। মেয়েটি উঠতেই বাসটি টান দিলো।
বাসের ভিতর তেমন কোনো জায়গা নেই। মেয়েটির হাতে একটি ব্যাগ। তাই নিয়েই ঝুলে আছে। পিছনে হেলপার। আপু ভেতরে যান। মেয়েটির সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই। আনফর কিছুটা দৌড়ে এসেই বাসটির অন্য হাতলে ধরে ঝুললেন।
বাসটি চলছে। রোকেয়া স্মরণী ধরে আগারগাঁওয়ের দিকে। কিছু দূর যেতেই মেয়েটি দুইজন পুরুষের ফাঁক দিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করলো। তার চেষ্টা বৃথা। মেয়েটি দ্বিতীয় যে কাজটি করলো আনফর তার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। ভিতরের দিকে যাইতে গিয়ে বাধা পেয়েই পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির পাছা টিপে ধরলেন।
লোকটি হঠাৎ কুৎ করে একটা আওয়াজ দিয়ে এমন একটি লাফ দিলেন যে সামনের ৬ সাত জন পরে গেছে। মেয়েটি কোনো চিন্তা না করেই। একটা মুচকি হেসে ঠিক ফাঁকা দিয়ে ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখনও আনফর ছাড়া বিষয়টি বাকিরা কেউ ধরতে পারে নি। যারা পড়েছেন তারা সবাই ভুক্তভোগী লোকটির দিকে রাগী মুখে তাকিয়ে আছেন। একজন পাশ থেকে বলছে- বাসে দাঁড়াতে পারেন না তো উঠেন কেড়ে?
- আরও পড়ুন>> এক ঝাঁক মানুষের মুখ
গল্পটি আসলে আমি এভাবেই শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারলাম না। আমার ইচ্ছেটা আরো অধিক। আমি চাই মেয়েটি ঠিক এই ছেলেটির মতো করুক যে কিনা নারীকে দেখলেই ঢেঁশ দিয়ে দাঁড়ান। নারীর পিছনে হাত বুলানোই যার কাজ। যে নারীর বুকের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেন। পাছায় টিপে দেন। কিন্তু না ইচ্ছা থাকার পরও পারলাম না। আমার কলমটা থেমে গেলো। আমার মনে হয়ে গেলো অনেকগুলো কুসংস্কার। আমার বাবা এই গল্প পড়লে কি বলবে? আমার বন্ধু কিভাবে নিবে গল্পটা? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কিভাবে ব্যাখ্যা করবে? এইসব আরো কত কি ভাবনা।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমি আর গল্পটি লিখতে পারি নি। যেখানে একজন নারী একজন পুরুষের ভুমিকায় অবতীর্ণ হবেন। যেখানে নারী পুরুষকে হাতিয়ে দিবেন। পুরুষের বুক ছুঁয়ে দিবেন। পুরুষের পাছা টিপে চলে যাবেন। যেখানে একটি মেয়ে ইচ্ছে করেই একটি পুরুষের ধোনে গুতা মেরে অনায়াসে চলে যাবেন। পুরুষটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। কেননা সে তখন মেয়েদের মতই হতবাক হবেন। তার বোনটি তো এমন নয়?
বন্ধুদের কথা, সমাজের কথা, ধর্মের কথা ভেবে ভেবে আমি এসব গল্প লিখতে পারি না।
একদিন আমি মায়ের গল্প লিখতে গিয়ে লিখে ছিলাম- মা বাবাকে মারছেন। ছোট্ট একটা কারণ। বাবা অফিস শেষে তেজপাতা আনতে ভুলে গেছিলেন। কিন্তু লিখতে পারলাম না। শেষে লিখলাম বাবার একটি গল্প। যেখানে বাবা তরকারিতে লবণ না হওয়ায় মাকে মাড়ছেন। এই গল্পটা লিখার পর থেকে আমি গল্প লিখা বাদ দিছি। এখন আমি এসব গল্প লিখি না। মা বারণ করছেন। মা বলছেন- তোর বাবার হাতের মাইরগুলা আদর মনে হয়। আমি আমার বোনের কথা লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লিখা হলো না।
একদিন আমি উন্মাদ একটা মেয়ের গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। যে একটা পুরুষকে ধরে জোড় করে সেক্স করেছে। তার পেটে বাচ্চা নিয়েছে। পুরুষটি কেবল তাকিয়ে ছিলো। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেছিলো। কেউ এগিয়ে আসে নি। কেননা আশপাশের সবগুলো মেয়েই ছিলো উন্মাদ- তারাও পর্যায়ক্রমে পুরুষটিকে ধর্ষণ করেছিলো। শেষে পুরুষটিকে হত্যা করে বংশী নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার পুরুষত্বের কথা ভেবে গল্পটি লিখতে পারলাম না । আমি একজন পুরুষ। আমার একটি ধোন আছে। তার আছে ক্ষমতা। তাই প্রকৃত গল্পটি লিখতে পারি নি আজো।
লেখক পরিচিতি:
মাসুম মুনাওয়ার, জন্ম ১ মার্চ ১৯৮৮, ১৭ ফাল্গুন ১৩৯৪ সালে জীবনপুর, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হতে সরকার ও রাজনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। জাহাঙ্গীরনগরের একমাত্র সাহিত্য সংগঠন ও ছোটকাগজ ‘চিরকুট’-এর প্রতিষ্ঠাতা। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সূর্যকুসুম, জলবন।
অলংকরণ: আল নোমানের চিত্রকর্ম অবলম্বনে মীর রবি