বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় সামনে আসার পর প্রজাতি বিলুপ্তির বিষয়টি সব সময়ই আলোচনায় রয়েছে। কিন্তু ঠিক কত প্রজাতি এখন পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি তেমন। এক ধরনের ধারণার আশপাশেই মানুষকে কথা বলতে হয়েছে। এবার সে সুনির্দিষ্ট তথ্যই দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি পরিচালিত এক সমন্বিত গবেষণায় বলা হচ্ছে, গত আড়াই শ বছরের পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ৬০০ প্রজাতির গাছ। এ সংখ্যা একই সময়ে বিলুপ্ত পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও সরীসৃপের মিলিত সংখ্যার দ্বিগুণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণ ধারণার চেয়ে ৫০০ গুণ দ্রুতগতিতে গাছ বিলুপ্তির ঘটনা ঘটছে। কিন্তু বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পাচ্ছে না। একটি শতকে বিলুপ্ত হওয়া পশুপাখির সম্পর্কে হয়তো মানুষ মোটাদাগে একটি ধারণা রাখে। কিন্তু গাছের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। অনেকেই বলতে পারবে না, কোন গাছটি এখন আর দেখা যায় না।
জাতিসংঘ গত মাসে এ-সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়েছিল, বর্তমানে সব ধরনের প্রাণ মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক এ প্রতিবেদন বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি বলছে, বৃক্ষ প্রজাতির এ বিলুপ্তির তথ্য ভবিষ্যৎ বিলুপ্তি ঠেকাতে বড় ধরনের সহযোগিতা করতে পারে।
এ বিষয়ে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এলিস হামফ্রিস বলেন, ‘কোন কোন উদ্ভিদ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরির লক্ষ্যে এটিই প্রথম পরিচালিত কোনো গবেষণা। শুধু তা-ই নয়, এ গবেষণায় প্রজাতিগুলোকে নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি বিলুপ্তির স্থান ও কতটা দ্রুত তারা বিলুপ্ত হয়েছে, তারও সুনির্দিষ্ট তথ্য উঠে এসেছে।’
গবেষণার তথ্যমতে, এই বিলুপ্তির অধিকাংশই ঘটেছে দ্বীপাঞ্চল ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে। এ দুটি অঞ্চলই বড় বড় গাছের আবাস। বিশেষত কাঠ হয়, এমন গাছের সংখ্যা এসব অঞ্চলেই বেশি। আবার বৈচিত্র্যের দিক থেকেও এ দুই অঞ্চলই এগিয়ে রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মিলে এ গবেষণা করেন। তাঁরা দেখেন, গত আড়াই শ বছরে পৃথিবী থেকে ৫৭১ প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে। একই সময়ে পশু, পাখি ও সরীসৃপ মিলে বিলুপ্ত প্রজাতির সংখ্যা ২১৭। এ-সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি ‘নেচার ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশন’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, এই বিলুপ্তির পেছনে মানুষ অনেকাংশে দায়ী। প্রাকৃতিকভাবে প্রজাতি বিলুপ্তির গতি শুধু মানুষের উপস্থিতির কারণেই বেড়ে গেছে ৫০০ গুণ।
উদাহরণ হিসেবে বলছেন, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ চিলি থেকে চন্দনগাছ হারিয়ে গেছে শুধু প্রসাধনকাজে অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে। তাঁদের মতে, এমনকি বিলুপ্ত উদ্ভিদের যে সংখ্যা উঠে এসেছে, তাও বর্তমান বিলুপ্তির গতি বোঝার জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ, বর্তমানে মানুষের প্রকৃতি-ধ্বংসী কাজ আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়ে গেছে। তবে আশার কথাও আছে। এমন অনেক প্রজাতিরই সন্ধান পাওয়া গেছে, যা বিলুপ্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
এমনিতে ৫৭১টি উদ্ভিদের বিলুপ্তি হওয়াটাকে একটি সংখ্যা মনে হতে পারে। কিন্তু আদতে এর সঙ্গে পুরো পৃথিবীর অন্য প্রাণগুলোও জড়িয়ে আছে বাস্তুসংস্থানের কারণেই। কারণ এখনো এই গাছই অক্সিজেন ও খাদ্যের জোগানদাতা। ফলে উদ্ভিদের বিলুপ্তি অন্য প্রাণীর বিলুপ্তি ত্বরান্বিত হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
গবেষণাটির সহগবেষক রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ-এর ড. ইমিয়ার নিক লুগাধা বিবিসিকে বলেন, ‘উদ্ভিদের বিলুপ্তি সব প্রজাতির জন্য একটি বড় দুঃসংবাদ। কোটি কোটি প্রজাতি এই উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে মানুষও রয়েছে। তাই কোন অঞ্চল থেকে কোন প্রজাতি আমরা হারাচ্ছি, তা জানা থাকাটা জরুরি। বিশেষত বিপন্ন ও মহাবিপন্ন প্রজাতিগুলো রক্ষায় তাহলে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারব। এটি একই সঙ্গে এদের ওপর নির্ভরশীল অন্য প্রজাতিগুলোকেও বাঁচিয়ে দেবে।’
উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে বেশ কিছু প্রস্তাব রেখেছেন গবেষকেরা। এর মধ্যে রয়েছে, পৃথিবীর সব উদ্ভিদ প্রজাতির নিবন্ধন, উদ্ভিদের নমুনা সংরক্ষণের ব্যবস্থা জোরদার, উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের সার্বিক সহযোগিতা এবং অবশ্যই স্থানীয় উদ্ভিদের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় ঘটানোর কাজটি করা।