গত ৮ জুন ২০১৯ নরসিংদী জেলার শিবপুর থানাধীন মাছিমপুর গ্রামের মোসা. সাবিনা আক্তার (২১) নামের এক মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকারী ভিকটিমকে হত্যা করার পর ধর্ষণ করে শিবপুরের কাজিরচর পূর্বপাড়া সাকিনস্থ জনৈক নাছিম উদ্দিনের কলাবাগানের ভেতর লাশ গোপন করে রাখে।
এই ঘটনায় ভিকটিমের মা আফিয়া আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে নরসিংদী জেলার শিবপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। ঘটনাটি বিভিন্ন প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিকস ও অনলাইন মিডিয়াতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলে উক্ত এলাকাসহ দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়।
বর্ণিত ঘটনা ও মামলার প্রেক্ষিত বিবেচনা করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ১১ গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে। এবং সেই সাথে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন ও এর সঙ্গে জড়িত অপরাধী বা অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব ১১ এর একটি বিশেষ গোয়েন্দাদল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলেপ উদ্দিন (পিপিএম) এর নেতৃত্বে ও সহকারী পুলিশ সুপার শাহ মো. মশিউর রহমান (পিপিএম) এর সহযোগিতায় চাঞ্চল্যকর সাবিনা আক্তার হত্যা ও ধর্ষণের রহস্য উদ্ঘাটন এবং হত্যাকারী গ্রেপ্তারের জন্য বেশ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালায়।
- আরও পড়ুন >> নরসিংদীতে প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ
অবশেষে ১১ জুন ২০১৯ (মঙ্গলবার) রাত সাড়ে ৮টায় নরসিংদী জেলার শিবপুর থানাধীন কলেজ গেট এলাকা থেকে আসামি মো. সাইফুল ইসলাম (২৮) কে গ্রেপ্তার করে। তার পিতার নাম মৃত হানিফ ফকির। বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার দুলালপুর (খালপাড়) গ্রামে।
গ্রেপ্তারকৃত সাইফুলের স্বীকারোক্তি মোতাবেক র্যাবের আভিযানিক দল ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনগণের উপস্থিতিতে তার বাড়ির বাথরুমের ভেতর থেকে ভিকটিম সাবিনার মোবাইল ও সিম উদ্ধার করা হয় এবং বাড়ির পাশের একটি নোংরা নর্দমা থেকে তার ভ্যানিটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর সাবিনার ব্যবহৃত আয়না, চিরুনি, একটি ওড়না ও অন্যান্য প্রসাধনসামগ্রী পাওয়া যায়। এ ছাড়াও হত্যায় ব্যবহৃত আসামির পরিহিত শার্ট ও আসামির মোবাইল উদ্ধার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতকে জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযুক্ত মো. সাইফুল ইসলাম (২৮) নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার দুলালপুর গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। সে বিবাহিত, তার প্রথম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর সাহিনুর বেগম (২৩) কে বিয়ে করে। সেই ঘরে সাইফুলের ৫ বছর ও ১০ মাস বয়সের ২টি সন্তান রয়েছে। প্রায় ৩ মাস পূর্বে শিবপুর থানাধীন ধানুয়া কারীবাড়ী মাজারে সাইফুলের সঙ্গে ভিকটিম মাোসা. সাবিনা আক্তারের পরিচয় হয়। একপর্যায়ে সাইফুল তার দ্বিতীয় স্ত্রীর কথা গোপন করে সাবিনাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর প্রেক্ষিতে সাইফুল সাবিনার সাথে বিভিন্ন স্থানে মাঝে মাঝে দেখা করত। এ সময় কয়েকবার সে সাবিনার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে কিন্তু সাবিনা তাতে রাজি না হওয়ায় বিয়ের প্রলোভনে তা করার ফন্দি আঁটে।
আসলে এটা ছিল সাইফুলের সাবিনাকে ধর্ষণের ফন্দি মাত্র। তাদের এই প্রেমের সম্পর্কের কথা সাবিনা তার চাচাতো বোনকে জানায়। সাইফুল ও সাবিনা মিলে টান ছলনা গ্রামে সাবিনার চাচাতো বোনের বাসায় গিয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা করে।
এর বেশকিছু দিন পর পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক সাবিনা ও সাইফুল বিয়ে করার জন্য ঘটনার দিন অর্থাৎ ৬ জুন ২০১৯ তারিখ আনুমানিক বেলা সাড়ে ৩টার সময় শিবপুরে মিলিত হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক সাইফুল ভিকটিম সাবিনাকে নিয়ে সিএনজিযোগে শিবপুর থেকে টান ছলনা গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়।
আনুমানিক রাত সাড়ে ৯টার সময় প্রধান সড়ক থেকে সিএনজি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কলাবাগানের ভেতর দিয়ে সাইফুল সাবিনাকে নিয়ে টান ছলনা গ্রামের দিকে যেতে থাকে।
একপর্যায় কলাবাগানের ভেতর নির্জন স্থানে সাইফুল সাবিনার সাথে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। তখন সাবিনা সাইফুলকে বাধা দিলে সাইফুল বল প্রয়োগ করলে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয় ও সাবিনা উচ্চস্বরে চিৎকার করতে থাকে এবং বলতে থাকে ‘আমারে কই লইয়া আইছ, আমারে দিয়া আয়’।
তখন সাইফুল ধর্ষণের জন্য আগে থেকে গায়ের খোলা শার্ট দিয়ে সাবিনার গলা পেঁচিয়ে ও মুখ চেপে ধরে তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে। হত্যার পর সাইফুল মৃত সাবিনাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করে। অতঃপর সে সাবিনার বিবস্ত্র লাশ রেখে মোবাইল ও ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে তার নিজ বাড়িতে চলে যায়। সাইফুল সাবিনার ব্যবহৃত মোবাইল বন্ধ করে বাড়ির বাথরুমের ভেতর ও ভ্যানিটি ব্যাগ বাড়ির পাশে একটি নোংরা নর্দমায় ফেলে দেয়। ঘটনার পর সাইফুল আত্মগোপন করে।
ঘটনার পরের দ্বিতীয় দিন (৮ জুন ২০১৯) স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে জানা যায় যে, নরসিংদী জেলার শিবপুর থানাধীন কাজিরচর পূর্বপাড়া সাকিনস্থ জনৈক নাছিম উদ্দিনের কলাবাগানের ভেতর অজ্ঞাতনামা একজন মেয়ের বিবস্ত্র লাশ পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে জানা যায় যে, ভিকটিম সাবিনা আক্তারকে শ্বাস রোধ করে হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়েছে। পরবর্তীতে শিবপুর থানা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে সুরতহাল রিপোর্ট শেষে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
নিহতের মা আফিয়া আক্তার বাদী হয়ে নরসিংদী জেলার শিবপুর থানায় এ ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ৮, তারিখ ০৯/০৬/২০১৯, ধারা-৩০২/২০১/৩৪ দ.বি.)। বর্ণিত ঘটনার প্রেক্ষিতে র্যাব ১১ এর একটি গোয়েন্দাদল দ্রুত ঘটনাস্থলে প্রেরণ করা হয় এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহসহ উক্ত ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন ও অভিযুক্ত সন্ধিগ্ধ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করে। এরই প্রেক্ষিতে চাঞ্চল্যকর সাবিনা আক্তার হত্যা ও ধর্ষণকারী আসামি মো. সাইফুল ইসলাম (২৮) কে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে। তাকে নরসিংদীর শিবপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।