‘রাজহাঁস থেকে পালক উঠাও যতটা সম্ভব ততটা, তবে সাবধান- রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়’- ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রী জিন ব্যাপটিস্টে কলবার্টের এই বিখ্যাত উক্তি উচ্চারণ করলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
আর এ নীতি অনুসরণ করেই এক কোটি লোককে ‘করজাল’-এর আওতায় আনার ঘোষণা দিয়ে বাজেট (২০১৯-২০) প্রস্তাব পেশ করেন তিনি। ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এতে তিনি সমাজের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছেন।
বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের সরকারের কর রাজস্ব আহরণের মূলনীতি হচ্ছে- রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি করতে হবে। তবে সেটা করহার বাড়িয়ে নয়; বরং সেটা করতে হবে করের আওতা বিস্তৃত করে। পাশাপাশি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হল- আমরা কোনোভাবেই কোনো করদাতার ওপর বোঝা হিসেবে কর চাপিয়ে দেয়ার বিপক্ষে। সেক্ষেত্রে জিন ব্যাপটিস্টে কলবার্টের নীতি অনুসরণ করা হবে।
যদিও কর আওতার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু এ ব্যাপারে যথেষ্ট আশাবাদী অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, কর রাজস্ব আহরণ আমাদের কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারব যখন আমরা কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করতে পারব।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে এবার নতুন কোনো কর আরোপ করছি না। দেশে চার কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত। অথচ আয়কর দিচ্ছেন ২০-২২ লাখ জন। এ সংখ্যা আমরা ইনশাআল্লাহ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১ কোটিতে নিয়ে যাব।
আর বাকি নাগরিকদেরও চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে করজালের আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম অব্যাহত রাখব। তিনি আরও বলেন, দেশের নাগরিকরা সরকারকে রাজস্ব প্রদানে আগ্রহী। কিন্তু নানাবিধ কারণে আমরা সেই রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ হচ্ছি। এবার এদিকে বিশেষ নজর দেয়া হবে।
ব্যক্তিশ্রেণী ও কর্পোরেট করহার অপরিবর্তিত রেখেই ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বহুল আলোচিত ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনটি চার স্তরে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।
চাপের মুখে পড়বে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। তবে ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনাসহ ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপের ঘোষণা দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
এবার সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সয়াবিন, পামওয়েল, সানফ্লাওয়ার ও সরিষার তেলের দাম বাড়বে। কারণ এসব পণ্য আমদানির ওপর মূসক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। নিত্যপণ্য চিনিও বেশি দামে খেতে হবে। চিনির কাঁচামাল আমদানির ওপর স্পেসিফিক ডিউটি বাড়ানো হয়েছে।
এবার অভিভাবকদের বেশি দামে কিনতে হবে শিশুখাদ্য গুঁড়ো দুধ। এর ওপর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এবার নজর দিয়েছেন বিয়ে-শাদির ব্যবসা (মিডিয়া) ঘটকালির দিকে। এখন এ ব্যবসার খরচ বাড়বে। বাড়বে জ্যোতিষী ব্যবসার খরচও। এছাড়া টিভি ও অনলাইনের অনুষ্ঠানের ব্যয়ও বাড়বে।
আইসক্রিমপ্রেমীদের জন্য দুঃসংবাদ আছে প্রস্তাবিত বাজেটে। এখন থেকে আইসক্রিম কিনতে হবে বেশি দামে। পাশাপাশি মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর খরচ বাড়বে। এতে মাশুল গুনতে হবে একেবারেই নিুস্তর থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরের মানুষকে। আর উচ্চবিত্তদের চার্টার্ড বিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহারে খরচ বাড়ছে।
বেকার যুবকদের জন্য একটি সুখবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। নতুন বাজেটে ১০০ কোটি টাকার একটি ‘স্টার্ট আপ ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাব করেছেন। এখান থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করতে পারবেন বেকার যুবকরা। আর বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের তিনি নিরুৎসাহিত করেননি। প্রবাসীদের আয় (রেমিটেন্স) বৈধপথে প্রেরণে উৎসাহিত করতে নতুন অর্থবছর থেকে পাবেন ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা।
পাশাপাশি প্রবাসীদের বীমা সুবিধা আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীকে তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনীয় ইশতেহারের সঙ্গে তাল রেখে ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ স্লোগানে গ্রামের বৈশিষ্ট্য ঠিক রেখে সব ধরনের শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বাদ পড়েনি বেসরকারি চাকরিজীবীরাও।
তাদের জন্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে ইউনিভারসেল পেনশন অথরিটি গঠনের। এটি গঠন করা হলে সরকারি ও বেসরকারি প্রত্যেক চাকরিজীবী পেনশনের আওতায় আসবেন।
বাজেট প্রস্তাব ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কালো সুটকেস হাতে বেলা পৌনে ৩টায় বাজেট অধিবেশনে প্রবেশ করেন অর্থমন্ত্রী। গুরুতর অসুস্থতার মধ্যেও অর্থমন্ত্রী হাসপাতাল থেকে সরাসরি সংসদ ভবনে আসেন। তারপরও তার মুখে ছিল উচ্ছ্বাস।
কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে দলের সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতাদের তাকে সহযোগিতা করতে দেখা যায়। বেলা সাড়ে ৩টায় জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ অধিবেশন শুরু হয়।
দেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। ব্যক্তিগতভাবে অর্থমন্ত্রীর এটি প্রথম বাজেট। বাজেট উপস্থাপনের আগে অর্থমন্ত্রী তার হঠাৎ শারীরিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে কখনও নিজ আসনে বসে এবং দাঁড়িয়ে বাজেট উপস্থাপনের জন্য স্পিকারের অনুমতি চান।
স্পিকার তাকে অনুমতি দিলে শুরুতেই অর্থমন্ত্রীর অনুরোধে বাংলাদেশ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রমাণ্যচিত্র তুলে ধরা হয়। এতে পাকিস্তান আমলে বাঙালি জাতির ওপর বৈষম্য, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম, দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জন, পরবর্তী স্বৈরশাসকদের দুঃশাসন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তিন মেয়াদে দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সোপানে অগ্রযাত্রার চিত্র তুলে ধরা হয়।
তবে বাজেট প্রস্তাব পড়ার সময় অর্থমন্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে বাজেট প্রস্তাবের বক্তব্য পড়ার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিকাল ৪টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বাজেটের বেশকিছু অংশ উপস্থাপন করেন। এরপর বাজেটের বাকি অংশ পঠিত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন স্পিকার শিরীন শারমিন।
এদিকে বাজেট বক্তৃতার আগেই সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন দেয়া হয়। প্রতিবছর বাজেট উত্থাপনের আগে রেওয়াজ অনুযায়ী এই বৈঠকটি সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। মন্ত্রিসভার অনুমোদন পাওয়ার পর বাজেট বিলে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে এমন কোনো পদক্ষেপ প্রস্তাবিত বাজেটে ঘোষণা দেয়া হয়নি। এবারের বাজেট শুধু এক বছরের জন্য নয়, তৈরি করা হয়েছে ২০৪১ সালকে টার্গেট করে। তবে এই বাজেট সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে সরকারকে মুখোমুখি হতে হবে নানা প্রতিকূলতার।
যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রবৃদ্ধিতে অসমতা, বিনিয়োগ সংকট, সুশাসনের ঘাটতি, ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা, অর্থনীতির আকারে রাজস্ব আদায় কম, বৈদেশিক লেনদেন ঘাটতি। তবে এসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তিনি প্রবৃদ্ধিকে আগামী তিন বছরে ৮ দশমিক ৬ শতাংশের ঘরে নেয়ার স্বপ্ন দেখছেন।
বিশাল ব্যয়কে মেলাতে গিয়ে উচ্চ রাজস্ব আদায়ের হিসাবও করেছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তিনি ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চান ৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধিকে টেনে নিতে চান ৮ দশমিক ৬ শতাংশে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কম থাকবে। অন্যান্য পণ্যের দাম কিছুটা নিুমুখী থাকবে। ফলে দেশের ভেতর পণ্যের দাম বাড়বে না- এমন আশা থেকেই নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেটেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রাখা হয়েছে। অর্থনীতির মূলধারায় কালো টাকাকে ফিরিয়ে আনতে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্ক এবং আবাসন খাতে এ সুবিধা দেয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে যে স্থবিরতা, তা দূরীকরণে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
এছাড়া ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং দারিদ্র্যবিমোচনেও নেই তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা। অথচ টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে হলে আয়বৈষম্য নিয়ে এখনই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া কথা। তাছাড়া বাংলাদেশ এখন নিু মধ্যম আয়ের দেশ এবং দরিদ্রই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেট কাঠামো:
প্রস্তাবিত বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এটি চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি। এ ব্যয় মেটাতে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ আয় হবে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা।
আয় ও ব্যয়ের ফারাক ঘাটতি থাকবে (অনুদানসহ) ১ লাখ ৪১ হাজার ২১২ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া এ ঘাটতির পরিমাণ হবে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি। নতুন বাজেটে ব্যয় মেটাতে কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রস্তাব করা হচ্ছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ১০৩ কোটি টাকা।
এর মধ্যে এনবিআর কর রাজস্ব পরিমাণ হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, এনবিআরবহির্ভূত কর রাজস্ব পরিমাণ হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কর ব্যতীত আয় হবে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ আগামী বছরে দাঁড়াবে ৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।
এদিকে বাজেট প্রস্তাবে সামগ্রিক ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে নেয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়া হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেয়া হবে ৩ হাজার কোটি টাকা।
নতুন ভ্যাট আইন:
অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভ্যাট আইন-২০১২ আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে বাস্তবায়ন করা হবে। এ আইনটি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় জনবলসহ সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে আইনটি তদারকি করতে। নতুন ভ্যাট আইন করা হয়েছে চার স্তরের।
১৫ শতাংশ বহাল রাখার পাশাপাশি অন্য স্তরগুলো হচ্ছে ৫, ৭.৫ ও ১০ শতাংশ। তবে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন ভ্যাটের বিষয়ে খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট হার অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে আসেনি। অর্থাৎ কোন খাতে বা কোন পণ্যে কত শতাংশ ভ্যাট আরোপিত হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কার:
প্রস্তাবিত ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকিং খাত সংস্কারে ৬টি প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকিং খাত শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় কোনো প্রকার সংস্কার আমরা লক্ষ করিনি। ব্যাংক থেকে কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ শোধে ব্যর্থ হলে তার জন্য কোনো প্রকার ‘এক্সিট’-এর ব্যবস্থা ছিল না।
আমরা এবার এই কার্যক্রমটি আইন প্রক্রিয়ায় সুরাহার লক্ষ্যে একটি কার্যকর ইনসলভেন্সি আইন ও ব্যাংক্রাপ্টসি আইনের হাত ধরে ঋণগ্রহীতাদের এক্সিটের ব্যবস্থা নিচ্ছি। সংস্কারের মধ্যে রয়েছে পর্যায়ক্রমে ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়ানো, ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধন প্রয়োজনবোধে ব্যাংক একীভূতকরণ ও প্রয়োজন হলে ব্যাংক কোম্পানি আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করার লক্ষ্যে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার এক অঙ্কে রাখা হবে।
সামাজিক কল্যাণমুখী পদক্ষেপ:
প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান মোট জনবলের ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী নিয়োগ দিলে ওই প্রতিষ্ঠান ৫ শতাংশ হারে আয়কর রেয়াত সুবিধা পাবে। একই সঙ্গে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিওগুলোতে ১০ শতাংশ প্রতিবন্ধী নিয়োগ দেয়া হলে একই সুবিধা ওই সব প্রতিষ্ঠানও পাবে।
দক্ষতা উন্নয়নের জন্য জাতীয় মানবসম্পাদ উন্নয়ন তহবিল গঠনে প্রস্তাব করা হয়েছে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ১০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রণোদনা:
অর্থমন্ত্রী প্রণোদনামূলক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছেন। শেয়ারবাজারে শেয়ারহোল্ডারদের ক্যাশ ডিভিডেন্ট উৎসাহিত করতে স্টক ডিভিডেন্টের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতির ওপর স্থানীয় মূসক বাদ দেয়া হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসার শোরুমের ওপর মূসক তুলে দেয়া হয়েছে।
হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে গ্যাস-বিদ্যুৎ সেবার ওপর মূসক তুলে নেয়া হয়েছে। পিপিপির আওতায় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্মাণ সংস্থা, কনসালটেন্সি ফার্ম ও সুপারভাইজরি ফার্মে যোগদানকারী ও আইন পরামর্শক সেবার ওপর মূসক তুলে নেয়া হয়েছে। এদিকে পোশাক ও বস্ত্র খাতের করহার সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
এ সুবিধা ৩০ জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। ওষুধ শিল্পের ক্যান্সার রোগীদের ওষুধ তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াত সুবিধা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ী যাদের বার্ষিক টার্নওভার ৫০ লাখ টাকার কম, তাদের ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া প্রস্তাব করা হয়েছে। ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট নেয়ারও প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।
ভ্যাটমুক্ত টার্নওভারের সীমা ৫০ লাখ টাকা রাখা, টার্নওভার করের ঊর্ধ্বসীমা ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা, বিপুলসংখ্যক পণ্য ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়া ৫০ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদশালীদের নিট সম্পদের ওপর শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হারে বা প্রদেয় করের ৩০ শতাংশ এর মধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ সারর্চাজ গুনতে হবে।
যারা বাজেট ঘোষণা করেছেন:
বৃহস্পতিবার দেশের ইতিহাসে ১২তম ব্যক্তি হিসেবে বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এর আগে ১০ বছর টানা বাজেট দিয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এর আগে ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ। প্রথম বাজেটসহ তিনি মোট তিনবার (১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪ ও ১৯৭৪-৭৫) বাজেট পেশ করেন।
১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আজিজুর রহমান মল্লিক। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান টানা তিনবার (১৯৭৬-৭৭, ১৯৭৭-৭৮ ও ১৯৭৮-৭৯) বাজেট পেশ করেন। ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এমএন হুদা বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে এম সাইফুর রহমান ১৯৮০-৮১ ও ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে দু’বার এবং ১৯৯১-৯২, ১৯৯২-৯৩, ১৯৯৩-৯৪, ১৯৯৪-৯৫, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে পাঁচবার এবং ২০০২-০৩, ২০০৩-০৪, ২০০৪-০৫, ২০০৫-০৬, ২০০৬-০৭ পর্যন্ত আরও পাঁচবারসহ সর্বমোট ১২ বার বাজেট পেশ করেন।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দু’বার, ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২, ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ বারসহ সর্বমোট ১২ বার বাজেট পেশ করেন।
১৯৮৪-৮৫, ১৯৮৫-৮৬, ১৯৮৬-৮৭ ও ১৯৮৭-৮৮ এই চার অর্থবছর বাজেট দেন অর্থমন্ত্রী এম সায়েদুজ্জামান। ১৯৮৮-১৯৮৯ অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান মেজর জেনারেল এমএ মুনিম। তিনি দু’বার (১৯৮৮-৮৯ ও ১৯৯০-৯১) বাজেট পেশ করেন। ১৯৮৯-৯০ অর্থবছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন ওয়াহিদুল হক।
তিনি ওই অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে শাহ্ এএমএস কিবরিয়া ১৯৯৬-৯৭, ১৯৯৭-৯৮, ১৯৯৮-৯৯, ১৯৯৯-২০০০, ২০০০-০১ ও ২০০১-০২ অর্থবছরের মোট মোট ছয়বার বাজেট পেশ করেন। এছাড়া ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ এই দুই অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম।