বৃহস্পতিবার নতুন অর্থমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাজেট পেশ করেছেন। বরাবরের মতোই সরকারের সমর্থকরা বাজেটের ভূয়সী প্রশংসা করছেন। তারা বলছেন, গণমুখী বাজেট, জনকল্যাণমুখী বাজেট। আর বরাবররের মতোই সরকার বিরোধীরা বলছেন, বাজেট বাস্তব সম্মত নয়। কিন্তু নির্লিপ্ত বিচারে বাজেটের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ দেশের সব জনগণের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করার লক্ষ্যে একটি ইউনিভার্সাল পেনশন অথরিটি চালু করা হবে। এ ছাড়াও সরকারি কর্মচারিদের পেনশনের ক্ষেত্রে হয়রানি দূর করতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মধ্যে সব পেনশনারকে ইএফটি কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসা হবে যাতে পেনশনারদের ব্যাংক বা মোবাইল একাউন্টে সরাসরি পেনশনের টাকা পৌঁছে যায়। নিঃসন্দেহে এটি জনকল্যাণমূলক সিদ্ধান্ত। যদিও সব নাগরিকদের পেনশনের আওতায় আনা খুব সহজ কাজ নয়, তবুও এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতি সরকারের গুরুত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠেছে।
কেবল বরাদ্দ নয় মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী, হিজড়া ও চা-শ্রমিকসহ পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতাও বাড়ানো হয়েছে। এ খাতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে; যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরও বেশি মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার প্রত্যাশা ব্যক্ত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ বাবদ ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে পাঁচ বছরে এ খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করার অঙ্গীকার রয়েছে।
বর্তমানে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তাসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাই হলো ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’। যদিও বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; তবু অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এখনো বিপুলসংখ্যক। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ১২.৩০ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪.৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করছে সরকার। এই বাস্তবতায় বর্তমান বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সাড়ে ৭৪ লাখ মানুষ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছেন।
সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) ১৪টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চিহ্নিত করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে বাজেটে ‘বয়স্ক ভাতা’ কর্মসূচিতে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪৪ লাখে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতার বিষয়েও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে বয়স্ক ভাতাভোগীর মতো এ ভাতারও পরিধি ও বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪ লাখ উপকারভোগী প্রতিমাসে ৫০০ টাকা হারে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ১৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৭ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে পাশাপাশি উদ্বেগ দেখা দিয়েছে অন্য একটি সিদ্ধান্তে। তা হলো ট্যাক্স আইডেনটিটি নাম্বার বা টিআইএন নিয়ে। বাজেটের অর্থ বিলে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যার নামেই বিদ্যুৎ সংযোগ থাকুক না কেন, তাকেই টিআইএন নিতে হবে। প্রথমে সিটি কর্পোরেশন এবং পর্যায়ক্রমে জেলা পর্যায়ে তা বিস্তৃত করা হবে। বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এ কাজটি তদারক করবে আয়কর বিভাগ। এমনকি বর্তমানে যাদের বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে, তাদেরও টিআইএন নিতে হবে। কিন্তু এ পরিকল্পনা এখনই বাস্তবে রূপ দিতে চাওয়া কতটা সহজ? এখনই এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে সাধারণ মানুষ যে হয়রানির শিকার হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বুঝতে হবে- দেশে এমন অসংখ্য মানুষ আছে যাদের করযোগ্য কোনো আয় নেই; এমন মানুষ আছে যারা কখনো বুঝবেই না টিআইএন কী জিনিস! অধিকন্তু কর বিভাগ বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়ই বা কীভাবে করবে সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি? সুতরাং বাজেট প্রশংসনীয় হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুনরায় ভেবে দেখা দরকার আছে বলে আমরা মনে করি।