মিসরে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে মঙ্গলবার কড়া নিরাপত্তায় দাফন করা হয়েছে। আদালত চত্বরে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর একদিন পর তাকে দাফন করা হয়।
এভাবে তার মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। এক বছর দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল।-খবর এএফপির
মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বলছে, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সী এই সাবেক প্রেসিডেন্টের মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মেদিনাত নাসর শহরে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিসরের একনায়ক হোসনি মোবাররকে ক্ষমতাচ্যুত করার গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলো-
বিপ্লব
২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি গণজাগরনের মাধ্যমে তিউনেশিয়ার একনায়ক জাইন এল আবেদিন বিন আলীর পতন থেকে উৎসাহিত হয়ে মিসরের কায়রোতে জমায়েত হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা।
তারা মিসরের দীর্ঘসময়ের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর দাবি করেন।
মধ্য কায়রোর তাহরির স্কয়ারে ব্যাপক বিক্ষোভের পর ১১ ফেব্রুয়ারি মোবারকের সদ্যোনিয়োগ করা ভাইস প্রেসিডেন্ট উমার সুলাইমান ঘোষণা করেন যে প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
এ সময় বিক্ষোভকারীদের ওপর ধরপাকড়ে সাড়ে আটশ জন নিহত হয়েছেন।
ইসলামপন্থীদের বিজয়
২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১২ সালের জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনে অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়েছেন ইসলামপন্থী দলগুলো। এটি ছিল মিসরের প্রথম কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন।
২০১২ সালের ৩০ জুন মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ৫১ দশমিক সাত শতাংশ ভোট পেয়ে মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক ও বেসামরিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। দেশটির প্রথম ইসলামপন্থী প্রধানও হলেন তিনি।
জুনে মিসরের সামরিক শাসকরা পার্লামেন্ট ভেঙে দেন। আগস্টে সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল হোসেইন তানতাওয়িকে বরখাস্ত করে আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
মুরসি ক্ষমতাচ্যুত
২০১৩ সালের ৩ জুলাই মুরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জের ধরে সিসি তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে কারাবন্দি করেন। মুরসিও তার সমর্থকদের মাঠে নেমে আসতে বলেন।
১৪ আগস্ট মুরসি সমর্থকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। এতে সাত শতাধিক লোক নিহত হন।
ডিসেম্বরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
প্রেসিডেন্ট সিসি
২০১৪ সালে মে-তে ৯৬ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সিসি। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতাকে আরও মদদ দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করা হয়।
২০১৫ সালের শেষ দিকে সিসির সমর্থকদের দিয়ে নতুন পার্লামেন্ট গঠন করা হয়।
নিপীড়ন
মিসরীয়দের ওপর ভয়াবহ নিপীড়নের নেতৃত্ব দেন সিসি। হাজারো ইসলামপন্থীকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসবের নিন্দা জানিয়ে আসছে।
তবে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধীরাও সিসির নিপীড়ন থেকে রেহাই পাননি। তাদেরও কারাগারে ভরা হয়েছে।
মিসরে নির্যাতন, গুম, বিনাবিচারে হত্যা ও ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনসহ ব্যাপক নিপীড়নের নিন্দা জানিয়েছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো।
কর্তৃপক্ষ সবসময় অভিযোগ অস্বীকার করে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে আসছেন।
সিসিকে সমর্থন
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক দশকের মধ্যে প্রথম রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কায়রো সফর করেন। সেখানে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি নির্মাণের চুক্তি সই করেন পুতিন।
ওই বছরের মার্চে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সামরিক সহায়তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহার করে নেয় তৎকালীন ওবামা প্রশাসন।
২০১৬ সালের এপ্রিলে সৌদি বাদশাহ মিসর সফর করেন।
২০১৭ সালের এপ্রিলে সিসির ওয়াশিংটন সফরে মিসরীয় নেতা হিসেবে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৯ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র যান সিসি।
২০১৮ সালের অক্টোবরে প্যারিস সফরে যান সিসি। সেখানে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়ের ম্যাক্রন তাকে জোরালো সমর্থন দেন। পরবর্তী সময় জানুয়ারিতে মিসর সফর করেন ম্যাক্রন।
সিসির শক্তিবৃদ্ধি
২০১৮ সালের মার্চে ৯৭ দশমিক ০৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ফের নির্বাচিত হন তিনি। সিসির বিরোধী প্রার্থীও ছিলেন তার একজন সমর্থক।
২০১৯ সালের এপ্রিলে এক বিতর্কিত সাংবিধানিক সংশোধনীতে তার ক্ষমতার মেয়ার বৃদ্ধির অনুমোদন করা হয়। গণভোটের মাধ্যমে তার ক্ষমতা অনুমোদন করা হয়।