সরকারের দুর্নীতিবিরোধী তৎপরতা থামিয়ে দেয়ার উদ্দেশে বিমানের দুর্নীতিবাজরা একযোগে মাঠে নেমেছে।এ জন্য তারা তহবিল গঠন করে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার রাতে উত্তরায় একত্রিত হয়ে বৈঠক করে তারা। বৈঠকে নেতৃত্ব দিয়েছেন খোদ বিমানেরই এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা, যিনি দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন।
তার নেতৃত্বে বিমান শ্রমিক লীগ, বিমান সিবিএ ও বিমান পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) ১০-১২ জন প্রভাবশালী নেতা উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া জনসংযোগ বিভাগের সাবেক একজন কর্মকর্তা এবং ঢাকার বাইরে বদলি হওয়া ৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বৈঠকে সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিভিন্ন অভিযোগে বিমানের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিবিএ নেতাকে বহিষ্কার, ওএসডি ও বদলি করা হয়েছে তাদেরকে অবিলম্বে পুনর্বহাল করতে মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যদি মন্ত্রণালয় তাতে রাজি না হয়, তাহলে বাপা ও সিবিএ মিলে আগামী হজ ফ্লাইট চলাকালে বড় ধরনের আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে দু’দফায় বৈঠকের স্থান বদল করেও তারা গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে পারেনি।
গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বুধবার সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়া সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম-পরিচয়ও উল্লেখ করা হয়েছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি অবগত হয়েছে।
বৈঠকে কারা উপস্থিত ছিলেন এবং কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ও জানতে পেরেছে। একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, বৈঠকে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থার নিজস্ব সোর্স থাকায় ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি জানা সম্ভব হয়েছে।
সূত্র জানায়, মূলত তারা বিমানের দুর্নীতিবিরোধী প্রক্রিয়ার সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের যারা সম্পৃক্ত তাদেরকে অন্যত্র বদলি করার মিশন বাস্তবায়ন করতে চান। তারা মনে করেন, বিমান সচিবসহ এ বিষয়ে তৎপর কয়েকজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিতে পারলেই সবকিছু দফারফা হয়ে যাবে। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পক্ষে আর শক্ত মনিটরিং ও ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না।
এ ছাড়া বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে- যেসব গণমাধ্যমে বিমানের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে তাদেরকে নানাভাবে বয়কট করা হবে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে যেসব কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে ওএসডি, বদলি কিংবা সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে সেসব আদেশ বাতিল করে তাদেরকে স্বপদে পুনর্বহাল করা হবে।
এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বিমানের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। যিনি প্রায় এক মাস বিদেশে অবস্থান করে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ষড়যন্ত্রকারী এ অংশটি এই ঘটনার অবতারণা করে রীতিমতো প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ করছে। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা, সাহস ও উৎসাহ দেয়া এবং এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জোরদার মনিটরিং ব্যবস্থার কারণে ইতিমধ্যে বিমানের টিকিটিং দুর্নীতিসহ ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি জালিয়াতি অনেকাংশে কমে এসেছে।
গত অর্থ বছরে যেখানে ২০১ কোটি টাকা বিমান লোকসান দিয়েছে সেখানে এবার লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে টিকিটিং দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গেছে। আশার কথা, এবার হজ ফ্লাইট পরিচালনায় বিমানের ৬৩ হাজার ৫০০ টিকিটের মধ্যে ৬১ হাজার ৫০০ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
ফলে টিকিট বিক্রি না হওয়ার অজুহাতে এবার কোনো ফ্লাইট বাতিল হবে না। অপরদিকে এবার হজযাত্রীদের জেদ্দায় গিয়ে ইমিগ্রেশন চেকিংয়ের জন্য কোনো ভোগান্তির শিকার হতে হবে না।
কিন্তু তারপরও গোপন বৈঠক করে এবারের হজ ফ্লাইট নিয়ে বড় ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরির পরিকল্পনা করছে চক্রটি। এর মধ্যে রয়েছে- যথাসময়ে ফ্লাইট না ছেড়ে বিলম্ব করা, ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে ও অবতরণের পর বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত গাড়ি ও আনুষঙ্গিক যানবাহন না পাঠিয়ে হজযাত্রীদের ভোগান্তিতে ফেলা।
যথাসময়ে লাগেজ ডেলিভারি না দিয়ে বিমানবন্দরে হজযাত্রীদের মধ্যে হইচই বাধিয়ে দেয়া। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে এর কিছু কাজ করবে বাপার কয়েকজন অসাধু ও দুর্নীতিবাজ সদস্য আর ফ্লাইটের বাইরে থেকে বিমানবন্দর এলাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে বিমান সিবিএর কতিপয় দুর্নীতবাজ নেতাকর্মী।
এর মধ্যে বিমানের মোটর ট্রান্সপোর্ট শাখা, গ্রাউন্ড সার্ভিস বিভাগ, বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং শাখা, ও বিমান প্রকৌশল শাখার কতিপয় দুর্নীতিবাজ সিবিএ নেতাকে ফ্লাইটের বাইরে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর উত্তরায় আর্টিসান ভবনে প্রশাসনের আমলাদের গোপন বৈঠকটি দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। যা এখনও ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’ নামে অভিহিত। মঙ্গলবার উত্তরায় বিমানের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গোপন বৈঠকের মধ্য দিয়ে তা নতুন করে ভিন্ন মাত্রা পেল।
সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তার সঙ্গে বিমানের পাইলট অ্যাসোসিয়েশন ও সিবিএর প্রভাবশালী নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বিমান ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে তার সরাসরি সম্পর্ক না থাকলেও তার নির্দেশনা ছাড়া বিমানে কোনো কাজ হয় না।
সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে নেতৃত্বদানকারী ওই শীর্ষ কর্মকর্তা হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, তিনি বিমানে আছেন বলে বিমানের সব শ্রেণীর কর্মচারীদের প্রমোশন, পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে ও হয়েছে। পাইলটরা বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।
যদি কোনো কারণে ক্ষমতা তার হাত থেকে মন্ত্রণালয়ের কাছে চলে যায়, তাহলে মন্ত্রণালয় আগের সব সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেবে। একই সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক ও ক্যাজুয়াল নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেয়া হবে।
এ ছাড়া সিবিএ সভাপতি মসিকুর রহমানসহ যাদের যোগ্যতা আছে তাদের সবাইকে পদোন্নতি দিয়ে বাধ্যতামূলক অফিসার করে দেয়া হবে। এতে তাদের কেউ আর সিবিএ করার সুযোগ পাবেন না।
এ ছাড়া সব পর্যায়ের সিবিএ নেতাদের বাধ্যতামূলক ঢাকার বাইরে বিমানের বিভিন্ন স্টেশনে পোস্টিং করা হবে। অপরদিকে বৈঠকে অংশ নেয়া পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের হুশিয়ার করে বলা হয়েছে, যদি তারা পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ না করে তাহলে বকেয়াসহ একতরফাভাবে তারা যেসব বেতন-ভাতা বাগিয়ে নিয়েছিলেন সেটা বাতিল করে দেয়া হবে।
- আরও পড়ুন >> বিমানের অনিয়ম : খতিয়ে দেখতে সংসদীয় কমিটি গঠন
মূল কথা বৈঠকের মূল বক্তব্য ছিল বিমানের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা যাতে কোনোভাবে বিমান মন্ত্রণালয়ের হাতে না যায়। সব ধরনের ক্ষমতা যাতে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের হাতে থাকে।
জানা গেছে, গোপন বৈঠকের নেতৃত্ব দেয়া ওই কর্মকর্তা প্রতি মাসে বিমান থেকে নানাভাবে লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। এর আগে একাধিকবার ব্যক্তিগত সফরে বিদেশ গেলেও তিনি সফরের সব ধরনের খরচ বিমানের তহবিল থেকে নিয়েছেন।
বিমান শ্রমিক লীগের বিভিন্ন পোস্টার ও ব্যানারে সব সময় তার ছবি লাগানো হয়েছে যা বিমানের ইতিহাসে আর কোনো কর্মকর্তা করেননি। এ ছাড়া বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটির সদস্য না থেকেও তিনি প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ সম্মানী হিসেবে হাতিয়ে নিতেন। নিয়ম অনুযায়ী বিমানে তার নিয়মিত অফিস করার কথা না থাকলেও তিনি প্রতিদিন বিমানে অফিস করতেন।
এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, তার কারণে বিমানে এখন সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতের আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তার কারণে বারবার ভিভিআইপি ফ্লাইট নিয়ে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াতের আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় বিমানের যেসব পাইলট-কর্মকর্তা-কর্মচারী এতদিন ব্ল্যাকলিস্টেড ছিলেন তাদের নিয়ে এখন ভিভিআইপি ফ্লাইটের সিডিউল তৈরি করা হচ্ছে। বিমান প্রশাসনের শীর্ষপদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে।
অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের পাইলট-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নানাভাবে বিএনপি-জামায়াত বানিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ওএসডি করে রাখা হয়েছে। অদক্ষ, অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও মোসাদ্দিক আহম্মেদকে বারবার বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
পাইলট নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য মোসাদ্দিক আহম্মেদ ও এক পাইলটের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো ওই পাইলটকে বিমানের শীর্ষপদে বসানো হয়েছে।
শীর্ষপদে থাকা ওই পাইলট ও গোপন বৈঠকে নেতৃত্ব দেয়া কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘ দু’বছর বিমানের দুই পাইলটকে পদোন্নতি না দিয়ে তারা বসিয়ে বসিয়ে বেতন-ভাতা দিয়েছেন। এতে বিমানের প্রায় ৪ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। এ ঘটনায় আদালতের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত তারা আমলে নেননি।
এ ছাড়া বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুর্র্নীতিবাজ মাফিয়া চক্র ও গডফাদারদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তাদের অনেকেও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যতই ষড়যন্ত্র হোক না কেন, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা রয়েছে, বিমানকে দুর্নীতিমুক্ত করে শতভাগ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই দুর্নীতিবাজদের পক্ষে যারা তদবির করবে তাদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতিমধ্যে টিকিট দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন আর সিট খালি যাচ্ছে না। টিকিট বিক্রিতে আয় বেড়েছে। বিমানের অন্যান্য খাতে যারা দুর্নীতি করছে তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বিমান ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালক পর্ষদের একজন প্রভাবশালী সদস্যের বিরুদ্ধেও দুদক ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকার জন্য বলা হয়েছে। কাজেই সবার আমলনামা তৈরির কাজ চলছে। দুর্নীতিবাজ ও তাদের আশ্রয়দাতা কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।