বড় পরিবর্তনে মধ্য দিয়ে রোববার পাস হচ্ছে প্রস্তাবিত বাজেট

মত ও পথ রিপোর্ট

বাজেট
ফাইল ছবি

আগামী রোববার বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পাস হচ্ছে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। সাধারণ মানুষ বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাজারের কথা চিন্তা করে এসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, অর্থবিল ও বাজেট পাসের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে জাতীয় সংসদে বিস্তারিত বলতে পারেন।

গত ১৩ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট ও অর্থবিল- ২০১৯ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এরপর প্রস্তাবিত বাজেটের বেশকিছু বিষয় নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।

সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের খুশি করতে যেসব বিষয় সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে সেগুলোতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার।

আগের কয়েকটি অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থবিল বাজেট পাসের দিন আলোচিত-সমালোচিত বিষয়ে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করবেন বলে জানা গেছে।

প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করলেই সাধারণত সেটি কার্যকর বলে ধরা হয়। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবনাগুলো কার্যকর করেই অর্থবিল ও বাজেট পাস করা হয়।

বৃহস্পতিবার শেরেবাংলা নগরে অর্থমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করেন আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে বেশকিছু বিষয়ে পরির্তনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর নিকট পরিবর্তিত বিষয়গুলো উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয়ে পরিবর্তন আনতে সংসদে প্রস্তাব করবেন।

সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্রে বর্ধিত উৎসে কর প্রত্যাহার, বিদ্যুৎ সংযোগে টিআইএন বাধ্যতামূলক না করা, পুঁজিবাজারের রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর কর প্রত্যাহার এবং সিমেন্ট ও রডে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে আগামী শনিবার অর্থবিল- ২০১৯ এবং পরের দিন বাজেট পাস হবে।

সঞ্চয়পত্রে নতুন করে করারোপ হচ্ছে না

বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে কর রয়েছে ৫ শতাংশ। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সকল ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর উৎসে করা ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্ধিত এ কর আরোপের প্রস্তাব নিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে।

বলা হচ্ছে, এ কর বৃদ্ধি সমাজের মধ্যবিত্ত, অবসরভোগী ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের আয়ের ওপর সরাসারি আঘাত করবে। এমনকী সংসদে এ নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষাপটে সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত উৎসে কর প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের দুটি চিন্তা রয়েছে। একটি হচ্ছে- বাজারে প্রচলিত সকল ধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর থেকে বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে। অথবা, শুধুমাত্র পরিবার-ভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর তা প্রত্যাহার করা হবে।

সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তবে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের ওপর নাকি শুধুমাত্র পারিবারিক ও পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ওপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করা হবে- সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পাসের দিন তথা ৩০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্ধিত কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করতে পারেন।

উল্লেখ্য, পারিবারিক সঞ্চয়পত্র শুধুমাত্র মহিলারা ক্রয় করতে পারেন। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন অবসরভোগী চাকরিজীবীরা।

বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য বাধ্যতামূলক হচ্ছে না টিআইএন সার্টিফিকেট

করের আওতা বাড়াতে এবার বাজেটে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।

তবে বিষয়টিতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়িত হলে দেশের দরিদ্র মানুষের হয়রানি বাড়বে। একই সঙ্গে কর্মসময়ের অপচয়ের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হবে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে গত সোমবার (২৪ জুন) অর্থমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া সরকারের অন্যতম নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। ইতোমধ্যে ৯৩ ভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছেন। বর্তমানে বিদ্যুৎগ্রাহকের সংখ্যা সারাদেশে তিন কোটি ৩৪ লাখ। এর মধ্যে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের গ্রাহক সংখ্যা দুই কোটি ৬৪ লাখ। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এ গ্রাহকের মধ্যে এক কোটি ২০ লাখ লাইফ লাইন গ্রহক। অর্থাৎ এসব গ্রাহক মাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন।

তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থবিলে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেই কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিতে হবে। কিন্তু লাইন লাইফ গ্রাহকরা খুবই দরিদ্র। অনেকেই দিনমজুর। তাদের পক্ষে টিআইএন করা কষ্টদায়ক ও অমানবিক। তাছাড়া টিআইএন থাকলে প্রতি বছর আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়। যা ওই দরিদ্র শ্রেণির লোকদের জন্য হয়রানিমূলক, কর্ম-কালের অপচয়, একই সঙ্গে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনি করি। এমতাবস্থায়, বিদ্যুৎ সংযোগে টিআইএন থাকার প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রত্যাহার হচ্ছে পুঁজিবাজারের রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভের ওপর কর

প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজার বিকাশে একগুচ্ছ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে রিটেইন আর্নিং ও রিজার্ভ ৫০ শতাংশের বেশি হলে ১৫ শতাংশ কর ধার্য করার বিষয়টি। সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন, এ কর ধার্য হলে কোম্পানির পুঁজি গঠনের পথ রুদ্ধ হবে।

রিজার্ভ মূলত কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যবহার হয়। এ কর ধার্য হলে ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে নিরুৎসাহিত হবে। তাই এটি পরিবর্তন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে স্টক ডিভিডেন্টের পরিবর্তে ক্যাশ বা নগদ ডিভিডেন্ট প্রদানকে উৎসাহিত করতে কোনো কোম্পানি স্টক ডিভিডেন্ট প্রদান করলে এর লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এটিও প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

উঠে যাচ্ছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে অগ্রিম কর

নতুন ভ্যাট আইনে এবার অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাটের (এটিভি) পরিবর্তে ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি) বসানো হয়েছে। অর্থাৎ মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঢালাওভাবে ৫ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হবে। এতে দেখা গেছে, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার পণ্যে এ আগাম কর বসেছে। ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে এ আগাম করের টাকা ফেরত নিতে হবে। এ টাকা ফেরত পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাংকের সুদ গুণতে হবে ওই ব্যবসায়ীকে। ফলে আমদানি পর্যায়ে এসব যন্ত্রপাতি ও পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তাদের ওপর। বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট পাসের সময় তা পরিবর্তন করা হচ্ছে।

তুলে দেয়া হতে পারে সিমেন্ট-রডে অগ্রিম আয়

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ১৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর (এটি) ধরা হয়েছে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ। ফলে এখন এ খাতে মোট ২০ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ভ্যাট ও অগ্রিম কর আরোপের কারণে সিমেন্টের এক টন কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বাড়বে ৮৫০ টাকা। এক টনে ২০ ব্যাগ সিমেন্ট হয়।

সে হিসাবে প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ৪২ টাকা বেড়ে যাবে। বাজেটে রড শিল্পের ওপর ৬৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। কাঁচামালে আগাম কর আরোপ এবং অগ্রিম আয়করের প্রভাবে টনপ্রতি রডের দাম বাড়বে প্রায় ১২ হাজার টাকা। সিমেন্ট ও রডের দাম বাড়লে সরাসরি প্রভাব পড়বে সরকারের উন্নয়নমূলক মেগা প্রকল্প ও আবাসন খাতে। মধ্যবিত্তের গৃহনির্মাণে খরচ বাড়বে। এ দুটি নেতিবাচক প্রভাব এবং ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত অগ্রিম আয়কর বা এটি তুলে দেয়া হচ্ছে।

প্রত্যাহার হতে পারে ই-কমার্সের ভ্যাট

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যবসা) ও ভার্চুয়াল বিজনেস বা অনলাইনে পণ্য বেচাকেনাসহ বেশকিছু খাতে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এ ভ্যাট হার কমানো হতে পারে।

শেয়ার করুন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে