খেলাপি ঋণ নিয়ে বিপাকে আছে পুরো ব্যাংক খাত। বেকায়দায় রয়েছে সরকারও। ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ ঘোষণা দিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রভাবশালীদের নানামুখী চাপে কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নিতে পারছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সর্বশেষ খেলাপি ঋণ কমাতে বিশেষ কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সেই কমিটিরও তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ কমিটি গঠন করে। খেলাপি ঋণ কেন বাড়ছে? কমানোর উপায় কী? এসব বিষয়ে সুপারিশসহ দ্রুততম সময়ে এ কমিটিকে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে দিতে বলা হয়।
ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আমজাদ হোসাইনের নেতৃত্বে বিশেষ এ কমিটিতে অফ-সাইট সুপারভিশন, ব্যাংক পরিদর্শনে নিয়োজিত চার বিভাগ, ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিস এবং ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বিভাগের মহাব্যবস্থাপকরা রয়েছেন।
- আরও পড়ুন>> প্রথমবারের মতো ওয়েব সিরিজে আমিন খান ও পপি
কিন্তু বিশেষ কমিটি গঠনের তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এখনও কোনো অগ্রগতি নেই। তিন সপ্তাহ পার হলেও একটি প্রাথমিক মিটিং করা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারেনি কমিটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কমিটি গঠনের পর প্রাথমিক পর্যায়ে একটি মিটিং হয়। মিটিংয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ছাড়া আর কিছু হয়নি। ফলে কমিটি গঠনের সময় দ্রুত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হলেও তা সম্ভব হবে না। কারণ কমিটি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। তাদের খেলাপি ঋণের বিষয়ে পরামর্শ পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। এসব কোনো উদ্যোগই নেই বিশেষ কমিটির।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এটি কোন উপায়ে কমানো যায় তা নির্ণয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।’
প্রতিবেদন জমা দিতে কত দিন সময় লাগবে- জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, ‘কমিটি কাজ করছে। সুপারিশ তৈরি করে প্রতিবেদন জমা দেবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে।’
এদিকে বরাবরই খেলাপি ঋণ কমাতে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয়া হচ্ছে। ঋণ আদায়ে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে আরও কঠোর করার সুপারিশও করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। উল্টো নানাভাবে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। সুদ মওকুফ, পুনঃতফসিল, পুনর্গঠন, স্বল্প সুদে ঋণ, অবলোপনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর প্রভাবশালীদের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব সুবিধা বাস্তবায়ন করছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। ফলে খেলাপি না কমে উল্টো বাড়ছে।
জাতীয় সংসদে শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অব্যবস্থাপনা ও নানা অনিয়মে দেয়া ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এছাড়া খেলাপিদের দৃশ্যমান কোনো শাস্তি না হওয়ায় খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা, যা ১৮ ডিসেম্বর শেষে ছিল ৯৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৬ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা।
২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তিন বছরে ৩৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ ‘বিশেষ ছাড়ে’ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সুদ মওকুফ হয়েছে দুই হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে তিন বছরে খেলাপিদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘খেলাপি বাড়ছে। এর মূল কারণ খেলাপিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। ঋণ নিয়ে অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। বছরের পর বছর ঘোরাচ্ছে, তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এছাড়া তাদের সুযোগ-সুবিধাও বন্ধ হয়নি। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ব্যাংক আরও সমস্যায় পড়বে।’
‘খেলাপি ঋণ কীভাবে কমাতে হয় তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে না। তাই ব্যাংক খাতে চলমান এ সমস্যা থেকে উত্তোরণের একমাত্র পথ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, এ খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া। এর কোনো বিকল্প নেই’- বলেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ।