রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলায় জেএমবির অন্যতম সমন্বয়ক তানভীর কাদেরীর ছেলেসহ তিনজন আজ মঙ্গলবার আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। অপর দুই সাক্ষী হলেন প্রত্যক্ষদর্শী ফাইরুজ মালিহা ও আলম চৌধুরী।
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান এদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষে আগামী ২৩ জুলাই পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে বাবা তানভীর কাদেরী মারা যান। মঙ্গলবার তারই ছেলে আজিমপুরে জঙ্গি আস্তানায় আসামি হলি আর্টিজান মামলায় বাবার জঙ্গি কার্যক্রম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেন।
দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ষোল বছর বয়সী এ ছেলে আজিমপুরে ‘জঙ্গি আস্তানায়’ মামলায় সে তার মায়ের সঙ্গে আসামি।
জবানবন্দিতে ওই কিশোর বলেন, ‘আমাদের পরিবারের মোট সদস্যসংখ্যা চারজন। বাবা (তানভীর কাদেরী) মা (আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা) আর আমরা দুই ভাই। ২০১৪ সালের দিকে আমার পরিবারসহ চারজন সেলটেকে থাকতাম। প্রতিদিনের মতো লাইফ স্কুলের মসজিদে বাবাসহ আমি নামাজ আদায় করতাম। একদিন আব্বু বাসায় এসে আম্মুকে বলেন, আমরা সপরিবারে হিজরত করব। এখানে যেমন কোনো পরিবেশ নেই, ভালো স্কুল নেই- হিজরতে ইসলামের পথে গেলে আর কোনো কষ্ট থাকবে না।’
‘এরই মধ্যে জাহিদ নামের এক আঙ্কেলের সাথে পরিচিত হয় আব্বুর। এ বিষয়ে আঙ্কেলের সাথে আব্বু আলোচনা করেন। আমাদের সবাইকে ইসলামের বায়াত গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে আব্বু আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে হ্যা বলে মত প্রকাশ করেন। এরপর আব্বুর কথামত ব্যাগ গোছাতে থাকি। বাসা থেকে বাহির হওয়ার সময় সবাইকে মোবাইল ফোনে কল দিয়ে জানান, সপরিবার মালয়েশিয়ায় ঘুরতে যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে সবার সাথে যোগাযোগ করবেন।’
‘এরপর পল্লবীর দিকে বাবা আমাদের বাসা ভাড়া নেন। সেখানে জাহিদ আঙ্কেলের সাথে আরও তিনজন আমাদের বাসায় আসেন। ওদের মধ্যে এক আঙ্কেল আমাকে চকলেট খেতে দেন। তারা আমাদের পেনড্রাইভ থেকে একটি ’ইসলামিক’ ফোল্ডার দিয়ে যান। ওই সময় মুসা নামের আরেক আঙ্কেল আমাকে আর আমার ভাইকে ইংরেজি বাংলা পড়াতে আসতেন। কিছুদিন পর চকলেট আঙ্কেল বলেন বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া নিতে। চকলেট আঙ্কেল বাসা দেখে আসেন। পরে সবাই মিলে ওই বাসায় ওঠি।’
‘কয়েক দিন যাওয়ার পর ওই তিনজন আরও দুজনকে বাসায় নিয়ে আসেন। তাদের একটি সংগঠন ছিল। সাংগঠানিক নাম ছিল, ছাদ, মাসুম, ওমর, আরিফ। এরপরে আরও তিনজন আসেন। জাহাঙ্গীর নামের আরেক আঙ্কেল তার পরিবার নিয়ে আসেন। জাহাঙ্গীর আর বাবা এক সাথে থাকতেন। তামিম নামের আরেক আঙ্কেল রুমে সাতজন থাকতেন। তাদের রুমে ঢোকা নিষেধ ছিল। ওই সাতজন সব সময় রুমে থাকতেন। মাঝে মাঝে আব্বুকে তালিম দিতেন। আমি আর আব্বু ওদের রুমে খাবার দিয়ে আসতাম বাহিরে থেকে। একদিন চকলেট আংকেল পাঁচটি ব্যাগ নিয়ে আসে। ওইগুলো তালিমের রুমে রেখে চলে যান।’
‘এর কিছু দিন পরে সারোয়ার নামের আরেকজন এসে আলোচনা করে চলে যান। তিন দিন পর জাহাঙ্গীর আঙ্কেল এসে সিরিস কাগজ দিয়ে চাপাতিতে ধার দিতে থাকেন। আম্মু জিজ্ঞাসা করলে তখন বলেন, ওইগুলো অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এরপর তিনজন বাইক নিয়ে বাহিরে চলে যান। তার কয়েক মিনিট পরে আরও দুজন বাহির হয়ে যান। যাওয়ার সময় বলে যান ওপারে জান্নাতে দেখা হবে। তারপর আব্বুকে বলে দ্রুত বাসা ছেড়ে মিরপুরের দিকে চলে যান।’
‘এরপর আব্বু আম্মুকে বলেন, আমি ট্যাক্সি আনতে যাচ্ছি তুমি ব্যাগ গুছিয়ে নিও। আব্বু ট্যাক্সি নিয়ে এলে আমরা এ বাসা ছেড়ে চলে যাই। এরপরে এক আংকেল জানান, একটি বড় অপারেশন হয়েছে। আব্বু তখন অনলাইনের খবরে দেখতে পান, হলি আর্টিজানে ব্যাপক গোলাগুলি চলেছে। সেই ঘটনায় যারা বাসা থেকে বাহির হয়ে গেছেন তারা সবাই মারা গেছেন। কয়েক দিন পর আরেক আংকেল রূপনগরে বাসা ভাড়া নিতে বলেন। এরপর আমাকে আর আম্মুকে আজিমপুরে পাঠিয়ে দেন। আব্বু আর ভাইয়া অন্য জায়গায় চলে যান।’
‘আজিমপুরে থাকা অবস্থায় দুজন মহিলা আসেন বাচ্চা সহকারে। জাহিদ আংকেল উনাদের নিয়ে আসেন। পরে জানতে পারি পুলিশের অভিযানে বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু হয়। আমাদের আজিমপুরের বাসায় পুলিশ অভিযান চালায়। সেখানে আমাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আর আম্মু হালকা আঘাত পান।’
এরপর বিচারক জিজ্ঞাসা করেন কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের মধ্যে কাউকে চিনেন কি না- উত্তরে দুজনকে চেনেন বলে বিচারককে জানান।
তিনি বলেন, আমরা যখন বসুন্ধরায় থাকতাম তখন র্যাস আংকেল ওরফে আসলাম ও জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব আসতেন।
আদালতে সাক্ষীর জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর আসামি আসলাম, রিগ্যান ও খালেদের পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ এ সাক্ষীকে জেরা করেন। কয়েকটি প্রশ্ন করার পর আজিরপুরে জঙ্গি আস্তানার মামলায় সে আসামি হওয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করতে গেলে বিচারক অপ্রাসঙ্গিক বলে বাধা দেন। তখন বিচারক ও এ আইনজীবীর মধ্যে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে আইনজীবী ফারুক ওকালতনামা লিখিতভাবে প্রত্যাহার করেন।
এরপর বিচারক ৩০ মিনিটের জন্য এজলাস ত্যাগ করে আবার উঠে ফাইরুজ মালিহা নামে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এরপর ওই তিন আসামিকে এ সাক্ষীকে জেরা করার কথা বললে তারা আইনজীবী নিয়োগ করে জেরা করবেন বলে জানান।
বিচারক পরবর্তী ধার্য তারিখে ওই সাক্ষীকে আসতে বলেন। এরপর আলম চৌধুরী নামে আরেক সাক্ষীর আংশিক জবানবন্দির পর বিচারক আগামী ২৩ জুলাই পরবর্তী সাক্ষীর দিন ধার্য করেন।